রাজনৈতিকভাবে ফলাফল হতে পারে মারাত্মক—এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মুখোমুখি হলে বিশ্বনেতারা কী করেন?
ভারতীয় সাংবাদিক মাহা সিদ্দিকীর মতে, এমন পরিস্থিতিতে নেতারা বিচ্যুতি খুঁজে বেড়ান।
খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের হাত রয়েছে বলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এক নিবন্ধে এ কথা বলেন মাহা সিদ্দিকী।
বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক আর. কেন্ট ওয়েভারের ‘দোষ এড়ানোর রাজনীতি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের প্রসঙ্গ টানা হয়।
ওয়েভারের নিবন্ধে বলা হয়, খারাপ সময়ে অর্থনীতি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আর তখন রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য এই সমস্যার প্রভাব ভোঁতা করার উপায় খুঁজে বের করেন।
বিশ্লেষণে বলা হয়, গত সপ্তাহজুড়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দোষ এড়ানোর একটি সর্বজনীনভাবে পরীক্ষিত রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে চলতি মাসের শুরুর দিকে (৯-১০ সেপ্টেম্বর) নয়াদিল্লি সফর করেছিলেন ট্রুডো। নয়াদিল্লি সফরের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ট্রুডো নিজ দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ছিলেন।
কানাডায় ক্রয়ক্ষমতার সংকট তথা খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে দেশটির রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন। তাঁকে তাঁরা চাপের মধ্যে রেখে ছিলেন।
ট্রুডো শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়েই হিমশিম খাচ্ছিলেন না। আবাসনসংকটসহ আরও নানা সমস্যার মুখোমুখি হন তিনি।
সেপ্টেম্বরে কানাডার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের অধিবেশনে এসব বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ার ব্যাপারে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ট্রুডো। পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন।
নয়াদিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রুডোর বৈঠক হয়। এই বৈঠকের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কানাডায় চরমপন্থীদের (খালিস্তানপন্থী) ভারতবিরোধী কার্যকলাপের বিষয়ে মোদি তাঁর অত্যন্ত উদ্বেগের কথা ট্রুডোর কাছে উত্থাপন করেন।
মোদির উদ্বেগের জবাবে ট্রুডো বলেছিলেন, অন্য দেশের বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের একটা বড় অংশের বসবাস রয়েছে তাঁর দেশে। তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পছন্দ-অপছন্দের অধিকার রয়েছে।
ভারতে দেওয়া ট্রুডোর বিবৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়। শব্দটি হলো-‘হস্তক্ষেপ’।
এক সপ্তাহ পরে কানাডার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের অধিবেশনে আবার এই ‘হস্তক্ষেপ’ প্রসঙ্গ তোলেন ট্রুডো।
১৮ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হরদীপ সিং হত্যায় ভারতের হাত রয়েছে। কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি তাঁর দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের আশঙ্কার কথা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারপর থেকে পশ্চিমারা নানা সময় নানা প্রেক্ষাপটে প্রকাশ্যে এই হস্তক্ষেপ শব্দটি ব্যবহার করে আসছে। শব্দটি আগে কানাডাকেও ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে তারা চীনের ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহার করে।
এখন ভারত কর্তৃক ‘হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ তুলে ট্রুডো নয়াদিল্লিকে বেইজিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করলেন। যদিও ট্রুডো তাঁর করা দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পার্লামেন্টে পেশ করেননি।
ভারতীয় সাংবাদিক মাহা সিদ্দিকীর মতে, হরদীপ সিং হত্যার বিষয়টি নিয়ে ট্রুডো যথাসম্ভব কূটনৈতিক উপায়ে এগোতে পারতেন। দুই দেশের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি তোলা যেত, তদন্ত করা যেত।
তা ছাড়া একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ট্রুডো পার্লামেন্টের বাইরেও এ-সংক্রান্ত অভিযোগ তুলতে পারতেন। কিন্তু তিনি অভিযোগ করার জন্য তাঁর দেশের পার্লামেন্টকেই বেছে নেন।
বিশ্লেষণে বলা হয়, ট্রুডো সম্ভবত এ কারণে পার্লামেন্টে অভিযোগটি করেছেন, যাতে বিষয়টি অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। পার্লামেন্টে অভিযোগ করে তিনি ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুতর একটি বিষয়ে পরিণত করেছেন।
কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন পার্লামেন্টে এ ধরনের অভিযোগ করেন, তার পরিণতি, কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা তিনি ভালোভাবেই জানেন। ট্রুডোও তা জানেন। তিনি সব জেনে-বুঝে, হিসাব কষেই এই ঝুঁকিটি নিয়েছেন বলে মনে করেন সাংবাদিক মাহা সিদ্দিকী।
কানাডা এমন একসময়ে অভিযোগটি তুলেছে, যখন চীনের পাল্টা হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য। ফলে ভারত সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াটা এই দেশগুলোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।
অতীতে এই দেশগুলো রাশিয়া, চীনের মতো দেশের বিরুদ্ধে কথিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে। এই অতীত অবস্থানের কারণে এখন তারা কেউ ট্রুডোর দাবিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। এই পরিস্থিতি ট্রুডোর জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি করেছে বলে মনে করেন মাহা সিদ্দিকী।