নন্দিত ও নিন্দিত- একাধারে এ দুটো শব্দই প্রয়োগ করা হয় নরেন্দ্র মোদির বিষয়ে। জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের ১৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন। এর আগে প্রাণবন্ত, দক্ষ ও সক্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে পুরস্কার স্বরূপ তিনি ২০০১ সালে গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদ পান। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের এই রাজ্যটিকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর ভূমিকা প্রশংসিত হয়। তবে একই সময়ে গুজরাটে দাঙ্গার কারণে তিনি চরমভাবে নিন্দিত হন। বলা হয়, তাঁর ইন্ধনেই ২০০২ সালে ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে গুজরাটে। এতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যার অধিকাংশই মুসলিম। তবে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
ওই দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা দেওয়া থেকে বিরত থাকে। যুক্তরাজ্য তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে এক দশক পর পরিস্থিতি আর তেমন নেই। বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ মূল ধারার রাজনীতিতে পুর্নভিবাব ঘটান। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভাগ্যও তাঁর সহায় থেকেছে। নিত্য পণ্য বিশেষ করে তেলের সস্তা মূল্যের কারণে তিনি প্রশংসা পেতেই পারেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বচ্ছ ও আধুনিক ভারত গড়তে তাঁর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ রয়েছে। তাঁর সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষ করে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে তিনি রীতিমতো দৌড় ঝাঁপ করেছেন।
রাজনীতির একদম শীর্ষে মোদির আরোহণ বিস্মিত করে অনেককে। সমালোচকেরা বলতেন, গুজরাট দাঙ্গার কারণে মোদি কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। ওই ঘটনার ঝাপটা থেকে তিনি বাঁচতে পারলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মায়া কোদনানির ২৮ বছরের জেল হয়। দাঙ্গার ঘটনায় নরেন্দ্র মোদিকে কখনো অনুশোচনা করতে বা ক্ষমা চাইতে দেখা যায়নি। সহিংসতা অব্যাহত থাকলে অনেক মুসলিম বাড়িঘর ছেড়ে গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী আহমেদাবাদের কাছে ঘেট্টসে বসবাস শুরু করেন। বিশ্লেষকদের মতে, কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সুনজরে থাকায় মোদির গায়ে কখনো আঁচড় পড়েনি। গুজরাটে আরএসএসের শক্ত ভিত্তি রয়েছে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত আরএসএসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। মোদির দল বিজেপির সঙ্গে এর সুসম্পর্ক রয়েছে। ১৯৮০ সালে বিজেপি গুজরাটে যোগ দেওয়ার আগে তিনি আরএসএসে প্রশিক্ষিত প্রচারক হিসেবে বহু বছর কাজ করেছেন। সুবক্তা, গোপনীয়তা রক্ষা ও দুর্দান্ত সংগঠক হিসেবে দলে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ভূমিকম্পে গুজরাটে প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় মোদির পূর্বসূরিরা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ওই সময় রাজনীতির মাঠে বড় ধরনের সুযোগ পান নরেন্দ্র মোদি। ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা চার বার তিনি বিজেপির প্রার্থী হিসেবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন।
নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত জীবনও মসৃণ নয়। সমালোচকেরা বলেন, তিনি স্ত্রী যশোদাবেনকেও বঞ্চিত করেছেন। ১৭ বছর বয়সে পরিবারের পছন্দে তিনি যশোদাবেনকে বিয়ে করেন। তবে এই দম্পতি খুব কম সময়ই একসঙ্গে সংসার করেছেন। তাঁর এই ব্যক্তি জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বরাবরই তিনি তা এড়িয়ে গেছেন। জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি প্রথমবার প্রকাশ্যে বিয়ের কথা স্বীকার করেন।
গুজরাটের মেহসানা জেলায় ছোট্ট একটি গ্রাম ভাদনগরে জন্ম নেন নরেন্দ্র মোদি। ভারত স্বাধীন হওয়ার তিন বছর পর ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি জন্ম নেন। তাঁর বাবার নাম দামোদারদাস মোদি এবং মায়ের নাম হিরাবা মোদি। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিনি বড় হন। সেই অবস্থা থেকে তাঁর উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়। ভাদনগর রেল স্টেশনে তাঁর বাবার চায়ের ছোট দোকান ছিল। ছেলেবেলায় পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে তিনিও চা বিক্রি করেছেন। পড়াশোনা ও বিতর্কে খুব আগ্রহ ছিল তাঁর। এমনও হয়েছে, বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ঘণ্টার ঘণ্টা তিনি পড়াশোনা করেছেন। গুজরাট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ করেন।