পুরুষাঙ্গের ক্যানসার বাড়ছে, কারা আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে
বিশ্বব্যাপী পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্তের হার বাড়ছে। ব্রাজিলে গত এক দশকে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬ হাজার ৫০০ জনের বেশি পুরুষের অঙ্গচ্ছেদ করতে হয়েছে।
ব্রাজিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জোয়াও (ছদ্মনাম)। ২০১৮ সালে তিনি তাঁর পুরুষাঙ্গে একটি আঁচিল দেখতে পান। কেন এই আঁচিল হলো, তা জানতে তিনি অনেক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
৬৭ বছর বয়সী জোয়াও বলেন, ‘এটি কী, তা জানতে আমি অনেক হাসপাতালে যাওয়া শুরু করি। কিন্তু সব চিকিৎসকই বলেছেন, পুরুষাঙ্গে এটি অতিরিক্ত ত্বক। কেবল এর থেকে নিরাময় করতে ওষুধ লিখে দেন চিকিৎসকেরা।’
কিন্তু ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও তাঁর আঁচিল বাড়তে থাকে। এটি তাঁর দাম্পত্য জীবনের ওপরও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। জোয়াও ও তাঁর স্ত্রীর যৌন চাহিদা কমতে থাকে। তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমরা অনেকটা ভাইবোনের মতো ছিলাম।’ বিষয়টি কী, তা জানতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
জোয়াও বলেন, তিনি পাঁচ বছর ধরে বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়েছিলেন। নতুন নতুন ওষুধ দিতেন চিকিৎসকেরা। বায়োপসিও করানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই এর সমাধান হয়নি। শেষমেশ ২০২৩ সালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শনাক্ত হয়, জোয়াওর ওই আঁচিল আসলে পুরুষাঙ্গের ক্যানসার।
অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি আমার পরিবারের জন্য খুব অপ্রীতিকর ও বিস্ময়ের চেয়ে আরও বেশি কিছু ছিল। কারণ, আমাকে পুরুষাঙ্গের একটি অংশ কেটে ফেলতে হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে, আমার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে।’
জোয়াও বলেন, ‘এটা এমন একধরনের ক্যানসার, যা নিয়ে আপনি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। কারণ, মানুষ এটি নিয়ে রসিকতা করতে পারে।’
পুরুষাঙ্গের ক্যানসার একটি বিরল রোগ। তবে এ ঘটনা ও এতে মৃত্যুর হার বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জোয়াওয়ের দেশ ব্রাজিলে প্রতি এক লাখ পুরুষের মধ্যে ২ দশমিক ১ জনের এই রোগ হয়, যা এ–যাবৎকালে সর্বোচ্চ হার।
অস্ত্রোপচারের আতঙ্ক
ব্রাজিলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ২১ হাজার ব্যক্তির পুরুষাঙ্গের ক্যানসার হওয়ার খবর নথিভুক্ত হয়েছে। এতে ৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর গত এক দশকে গড়ে প্রতি দুই দিনে একজনের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে। সংখ্যায় যা ৬ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি।
ব্রাজিলের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য মারানহাও। বিশ্বব্যাপী পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে সর্বোচ্চ আক্রান্তের হার এই রাজ্যে বেশি। এখানে প্রতি এক লাখ পুরুষের মধ্যে ৬ দশমিক ১ জন পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্ত।
পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের লক্ষণ শুরু হয় একটি ঘা দিয়ে। যা কিছুতেই নিরাময় হয় না এবং ওই ঘা থেকে তীব্র গন্ধযুক্ত স্রাব বের হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে রক্তপাত হয় এবং পুরুষাঙ্গের রং পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এই ক্যানসার প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্ষত অপসারণ, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার ভালো সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যদি চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে পুরুষাঙ্গের আংশিক বা সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ এবং আশপাশের যেমন অণ্ডকোষও কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।
গত জানুয়ারিতে জোয়াও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুরুষাঙ্গের আংশিক অঙ্গচ্ছেদ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি একটি কঠিন সময়। এটি এমন কিছু, যা আপনি কল্পনাও করেননি।’
জোয়াও বলেন, ‘আমি অস্ত্রোপচারের জন্য আতঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। অস্বীকার করতে পারি না যে, অস্ত্রোপচারের পর প্রথম সপ্তাহের অনুভূতি ছিল দুঃখজনক। আপনার পুরুষাঙ্গের একটা অংশ না থাকাটা ভয়াবহ।’
তবে কোনো কোনো রোগীর পুরুষাঙ্গের সম্পূর্ণ অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। এতে জীবন বদলে যায়। সাও পাওলোর এসি ক্যামার্গো ক্যানসার সেন্টারের ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক থিয়াগো ক্যামেলো মুরাও বলেছেন, ‘আংশিক অঙ্গচ্ছেদের ক্ষেত্রে, পুরুষাঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করায় কোনো জটিলতা হয় না।’
থিয়াগো ক্যামেলো মুরাও আরও বলেন, ‘তবে সম্পূর্ণ অঙ্গচ্ছেদের ক্ষেত্রে মূত্রনালির ছিদ্রটি অণ্ডকোষ ও মলদ্বারের মধ্যে পেরিনিয়ামে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে টয়লেটে বসে প্রস্রাব করতে হয়।’
ব্রাজিলিয়ান সোসাইটি অব ইউরোলজির চিকিৎসক মাউরিসিও ডেনার কর্ডেইরো বলেছেন, যৌন ভাইরাস হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের (এইচপিভি) ক্রমাগত সংক্রমণ এই রোগের ঝুঁকির প্রধান একটি কারণ। শারীরিক সংসর্গের সময় এইচপিভি সংক্রমণ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ মুখ ও পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
মাউরিসিও ডেনার কর্ডেইরো বলেন, সংক্রমণ ও ক্ষত প্রতিরোধে এইচপিভির বিরুদ্ধে গণটিকা দরকার। ব্রাজিলে এই টিকা দেওয়ার হার অনেক কম। ‘ব্রাজিলে ভ্যাকসিন সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের এইচপিভি টিকা দেওয়ার হার কম, মাত্র ৫৭ শতাংশ। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ৪০ শতাংশের বেশি নয়। রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা দেওয়ার আদর্শ হার হলো ৯০ শতাংশ।’
মাউরিসিও বিশ্বাস করেন, টিকা সম্পর্কে ভুল তথ্য, এর কার্যকারিতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন সন্দেহ এবং টিকার প্রচারের অভাবে মানুষ সচেতন নয়, টিকা কম নিচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ওয়েবসাইট অনুসারে, ধূমপান পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। পুরুষাঙ্গ পরিষ্কার রাখতে অগ্রভাগের চামড়া (পুরুষাঙ্গ আচ্ছাদিত ত্বক) যদি টানতে সমস্যা হয় (ফিমোসিস), তাহলে পুরুষাঙ্গের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।’
চিকিৎসক মাউরিসিও বলেন, ‘মানুষ যখন পুরুষাঙ্গের আচ্ছাদিত ত্বক উন্মুক্ত করে না এবং সঠিকভাবে সামনের চামড়া পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়, তখন এটি থেকে একধরনের ক্ষরণ হয়। ওই ক্ষরণ চামড়ার ভেতর জমা হয়। যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। আর যদি এটা বারবার ঘটে, তবে টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
তবে শুধু ব্রাজিলে পুরুষাঙ্গের ক্যানসার বাড়ছে তা নয়। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বিশ্বজুড়ে এই ক্যানসারে আক্রান্তের পুরুষের সংখ্যা বাড়ছে।
২০২২ সালে জেএমআইআর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স জার্নাল ৪৩টি দেশের সর্বশেষ তথ্যসংবলিত একটি বড় মাপের বিশ্লেষণের ফলাফল প্রকাশ করেছে।
এই ফলাফলে দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্তের সর্বোচ্চ ঘটনা পাওয়া গেছে উগান্ডায়। ওই সময় দেশটিতে প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে ২ দশমিক ২ জন এই ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এর পরের অবস্থানে ছিল ব্রাজিল, প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে ২ দশমিক ১ জন এবং থাইল্যান্ডে প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে ১ দশমিক ৪ জন এই ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। আর সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল কুয়েত, এই দেশে প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে শূন্য দশমিক ১ জন এই ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
চীনের সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেইওয়েন ফু ও তিয়ান তিয়ানের নেতৃত্বে একদল গবেষক গবেষণাটি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের উচ্চ প্রকোপ ও মৃত্যুর হার বেশি হরেও বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশে এ ঘটনা বাড়ছে।’
গবেষকেরা বলেছেন, ইংল্যান্ডে পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেড়েছে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সালে প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে ১ দশমিক ১ জন থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৩ জনে দাঁড়িয়েছে। জার্মানিতে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ১৯৬১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রতি ১ লাখ পুরুষের মধ্যে ১ দশমিক ২ জন থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৮ জনে দাঁড়িয়েছে।
গ্লোবাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রেডিকশন টুলের তথ্য অনুসারে, এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু উচ্চতর ক্যানসার ঝুঁকির কারণে করা হয়েছে। তারা ধারণা করছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের ঘটনা ৭৭ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যাবে।
মূলত বয়স্ক পুরুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এ ঘটনা ঘটেছে।
চিকিৎসক মাউরিসিও বলেন, ‘পুরুষাঙ্গের ক্যানসার একটি বিরল রোগ। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য।’ তিনি বলেছেন, যৌনাচারের সময় জন্মনিরোধক (কনডম) ব্যবহার করা এবং ফিমোসিসের ক্ষেত্রে অগ্রভাগের ত্বক অপসারণে অস্ত্রোপচার করা পুরুষাঙ্গের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ফ্রিমলি হেলথ এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের ইউরোলজি বিভাগের ক্লিনিক্যাল লিড নিল বারবার বলেছেন, ‘খতনা করানো জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্তের কথা প্রায় শোনা যায় না। দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি এবং পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের নিচে সংক্রমণ, পাশাপাশি ফিমোসিসের মতো অবস্থা যা সামনের চামড়া তুলে নেওয়া কঠিন করে তোলে।’
নিল বারবার বলেন, ‘অরক্ষিত শারীরিক সংসর্গ, বিশেষত কনডম ব্যবহার না করা এবং দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।’
জোয়াও বর্তমানে তাঁর সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টের অপেক্ষায় আছেন। এই রিপোর্ট তিনি চলতি বছরের শেষের দিকে পাবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে এসব পরীক্ষায় দেখা যাবে, আমি সুস্থ হয়ে ওঠার পথে। এখন অঙ্গচ্ছেদ করার পরের ব্যথা চলে গেছে। আগের চেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করছি। তবে বাকি দিনগুলো আমাকে আংশিক কাটা পুরুষাঙ্গ নিয়েই থাকতে হবে।’
ক্যানসার রিসার্চ ইউকের মতে, পুরুষাঙ্গের ক্যানসারে আক্রান্ত ৯০ শতাংশের বেশি পুরুষ, যাঁদের রোগটি রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অঙ্গ লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েনি, তাঁরা পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকেন।