ভারতজুড়ে ওয়াক্‌ফর বিপুল সম্পদ নিয়ন্ত্রণে নিতেই কি সংশোধনী আনল বিজেপি সরকার

ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের ওয়াক্‌ফ বোর্ডের সম্পত্তিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সংসদের উভয় কক্ষে বিতর্কিত ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল পাস করেছে। মুসলিম ও বিরোধীরা এই বিতর্কিত সংশোধনীর বিরোধিতা করলেও পাত্তা দেয়নি বিজেপি। এই বিল আইনে পরিণত হলে মুসলিমদের এই সংস্থার মালিকাধীন সম্পত্তির কী হতে পারে—তা নিয়ে আল–জাজিরা অনলাইনে লিখেছেন কাশিফ কাকভি। গত ২৫ মার্চ অনলাইনে লেখাটি প্রকাশিত হয়।

ভারতের লোকসভায় ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিলের বিরোধিতা করছে বিরোধীরা। ২ এপ্রিল, নয়াদিল্লিফাইল ছবি: এএনআই

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের মধ্যপ্রদেশের উজ্জেইন শহরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাড়ি, দোকান ও শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদসহ প্রায় ২৫০টি সম্পত্তি ও স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ২ দশমিক ১ হেক্টর জমি (৫ দশমিক ২৭ একর) খালি করতে এসব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব সম্পত্তির মালিক মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ড। ‘ওয়াক্‌ফ’ শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি—মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, এতিমখানা, হাসপাতাল এমনকি খালি জায়গা—সবকিছু ধর্মীয় ও দাতব্য কাজের জন্য আল্লাহর নামে দান করা। এসব সম্পত্তি স্থানান্তর ও বিক্রয় করা যাবে না বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

কিন্তু উজ্জেইনে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের সম্পত্তি কথিত মহাকাল করিডর নির্মাণের জন্য খালি করা হয়েছে। শহরের বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দিরের আশপাশে ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ে নেওয়া প্রকল্পের জন্য এই ভূমি খালি করা হয়েছে।  

২০ কোটির বেশি মুসলিমের বসবাস ভারতে। এই দেশে বিপুল পরিমাণ ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তিতে ৮ লাখ ৭২ হাজারের বেশি স্থাপনা রয়েছে, যাতে জমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার হেক্টর (১০ লাখ একর)। এসব সম্পদের দাম প্রায় ১ হাজার ৪২২ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতিটি রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ওয়াক্‌ফ বোর্ড এসব সম্পত্তি দেখাশোনা ও পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ বোর্ড।

শহর ও নগর এলাকায় ওয়াক্‌ফ বোর্ড হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বেশি জমির মালিক প্রতিষ্ঠান। আর সব মিলিয়ে হিসাব করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ভূমির মালিক হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান।  

ওয়াক্‌ফর সম্পত্তিতে ৮ লাখ ৭২ হাজারের বেশি স্থাপনা রয়েছে, যাতে জমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার হেক্টর (১০ লাখ একর)। এসব সম্পদের দাম প্রায় ১ হাজার ৪২২ কোটি মার্কিন ডলার।

ভারতের বিজেপি সরকার কয়েক দশকের পুরোনো ওয়াক্‌ফ আইনে সংশোধন আনতে দীর্ঘদিন ধরে তৎপরতা চালাচ্ছিল। গত বুধবার এই লক্ষ্যে লোকসভায় বিতর্কিত ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল পাস করা হয়েছে। পরে গত বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায়ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিজেপি সরকার অনায়াসে বিলটি পাস করিয়ে নিয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে ওয়াক্‌ফ আইনে ওয়াক্‌ফ বোর্ড এসব সম্পত্তির সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছিল। এই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার পুরো ক্ষমতা এই বোর্ডের। নরেন্দ্র মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রস্তাবিত বিলে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নজিরবিহীনভাবে সরকারের হাতে চলে যেতে পারে।

নতুন প্রস্তাবিত সংশোধনী আইন মসজিদ ও দরগাহের জমি দখলের শুরু মাত্র
সঞ্জয় সিং, সংসদ সদস্য, আম আদমি পার্টি  

মুসলিমরা অভিযোগ করছেন, মোদির প্রশাসন সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে আরও প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইছে।

এমনকি নানা টেলিভিশন বিতর্ক, কিছু সমাজকর্মী ও আইনজীবীদের বক্তব্যে মধ্যপ্রদেশের উজ্জেইন শহরের ঘটনাকে গভীরতর সমস্যার একটি উদাহরণ বলে উঠে এসেছে। তাঁরা বলছেন, ওয়াক্‌ফ বোর্ডের দীর্ঘদিনের জর্জরিত সমস্যা, বছরের পর বছর ধরে চলা অব্যবস্থাপনার কারণে এসব সম্পদ বেহাত হয়ে যেতে পারে। ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধনের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কাই বেশি।

কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট সংশোধনের জন্য আনা ওয়াক্‌ফ বিলের বিরোধিতা করে আসছিল। সংসদের উভয় কক্ষে বিলটি পাসের বিপক্ষে ভোটও দিয়েছে তারা। তবে বিজেপি তার শরিকদের নিয়ে এই সংশোধনী পাস করিয়ে নিয়েছে।

সরাসরি লঙ্ঘন

আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য মধ্যপ্রদেশে গত ২২ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত দলটি রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল না। ওই সময় মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে ক্ষমতা ছাড়তে হয় কংগ্রেসকে।

শহর ও নগর এলাকায় ওয়াক্‌ফ বোর্ড হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বেশি জমির মালিক প্রতিষ্ঠান। আর সব মিলিয়ে হিসাব করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ভূমির মালিক হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন উজ্জেইনের রাজনীতিক বিজেপির নেতা মোহন যাদব। এই রাজ্যে ২০২৮ সালে অনুষ্ঠেয় কুম্ব মেলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ওই বছর শিপ্রা নদীর তীরে কুম্ব অনুষ্ঠিত হবে। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই উৎসব মহাকুম্ব প্রতি ১২ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়। কুম্ব তীর্থযাত্রীদের অবস্থানের জন্য মহাকালেশ্বর মন্দিরের আশপাশে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দিয়ে সরকার দখল করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সমালোচকেরা বলছেন, রাজ্য সরকার ১৯৮৫ সালের নথিপত্রকে অগ্রাহ্য করেছে। যে নথি থেকে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে উজ্জেইনের ওই এলাকায় মুসলিম কবরস্থান ও ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন। বছরের পর বছর ধরে সেখানে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলো আবাসিক এলাকা তৈরি করতে অবৈধভাবে জমির প্লট বিক্রি করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে গত জানুয়ারিতে ২৫০টি স্থায়ী স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।  

আল–জাজিরার হাতে সরকারের ভূমি অধিগ্রহণের নথিপত্র এসেছে। তাতে দেখা যায়, উজ্জেইনের রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তা ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি অধিগ্রহণের রাজ্য প্রশাসনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তিনি তাঁর নোটে লেখেন, এখানকার বাসিন্দারা ১৯৮৫ সালের একটি গেজেট নোটিফিকেশন দেখিয়েছেন, যাতে প্রমাণিত হয় ওই সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ বোর্ডের।  

ওই কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, ওই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে হলে ওয়াক্‌ফ বোর্ড থেকে ‘অনাপত্তিপত্র’ নেওয়া উচিত। অবশ্য এক মাস পর উজ্জেইন জেলা প্রশাসন একটি আদেশ জারি করে জানায়, ‘সামাজিক কাজে কোনো ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে অনুমতিপত্র’ লাগে না।

ওয়াক্‌ফর ১ হাজার ১৪টি সম্পদের মধ্যে সরকারের মালিকানায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ৩৬৮টি, ব্যক্তিমালিকানায় ৪৫৪টি এবং ১৯২টি সম্পত্তির রেকর্ড হয় অসম্পন্ন নয়তো রেকর্ডই নেই
আশার ওয়ার্সি, আইনজীবী, মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্ট

আইনজীবী সোহাইল খান বলেন, ‘এই অধিগ্রহণ ওয়াক্‌ফ আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।’ এই আইনজীবী উজ্জেইনের ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করার বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।

গত জানুয়ারিতে যাঁদের বাড়ি ও দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকার অবশ্য তাঁদের ৩৩ কোটি রুপি (৩৮ লাখ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। শহরের অনেক বাসিন্দা তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ওয়াক্‌ফ বোর্ড কেন তখন ওই অর্থ দাবি করেনি। কারণ, দোকানপাট ও বাড়িঘর করতে অবৈধভাবে ওই সব ব্যক্তি ওয়াক্‌ফ বোর্ডের জায়গা দখল করেছিলেন।

কথিত মহাকাল লোক করিডরের জন্য উজ্জেইন জেলা প্রশাসন ২০২১ সালে নিজামুদ্দিন কলোনির বাড়িঘর ও দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেয়
ফাইল ছবি: এএনআই

মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ওয়াক্‌ফ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও উজ্জেইনের বিজেপি নেতা সানাওয়ার প্যাটেলকে আল–জাজিরার পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কেন অধিগ্রহণের বিরোধিতা বা ক্ষতিপূরণ দাবি করেননি। উত্তরে তিনি বলেন, ‘দল যা নির্দেশ দেবে, আমি তা–ই করব। কারণ, দলের সুবাদে আজ আমি এখানে।’

সানাওয়ার প্যাটেল বলেন, ওয়াক্‌ফ বোর্ডের পক্ষ থেকে উজ্জেইন জেলা প্রশাসনকে একটি চিঠি পাঠিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ ওয়াক্‌ফর জমিতে অবৈধভাবে বাড়ি করে থাকা ব্যক্তিদের না দিতে বলা হয়েছিল। তবে কেন তিনি প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানাননি, এমন প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি।

সানাওয়ার স্বীকার করেন, ওয়াক্‌ফ বোর্ডের মালিকানাধীন ৯০ শতাংশ জমি হয় অবৈধ দখলে রয়েছে অথবা আদালতে মামলা–মোকদ্দমা চলছে।

মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র আশিস আগারওয়াল দাবি করেন, রাজ্য সরকার উজ্জেইনে ‘চাহিদা অনুযায়ী’ ভূমি অধিগ্রহণ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে ‘আইনি বিষয় অনুসরণ’ করা হয়েছে। তিনি এর বেশি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।

ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না

ভারতে ওয়াক্‌ফ আইন প্রথম পাস করা হয় ১৯৫৪ সালে। সরকারের সহায়তা নিয়ে মুসলিমরা এই বোর্ড চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে সেই আইন সংশোধন করে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। এমনকি ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আদালতের বিকল্প এই ট্রাইব্যুনালকে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির বিরোধ মীমাংসার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।  

তবে গত মাসে মোদির মন্ত্রিসভায় ওয়াক্‌ফ (সংশোধন) বিল অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে পুরোনো ১৪টি আইনের ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংশোধনীতে কিছু বিতর্কিত ধারা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা। জেলা প্রশাসন থেকে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। বিরোধী মহলের দাবি, সরকারের এই বিল সংবিধানের পরিপন্থী।

বিরোধী আম আদমি পার্টির (এএপি) পার্লামেন্ট সদস্য সঞ্জয় সিং বলেন, নতুন প্রস্তাবিত সংশোধনী আইন মসজিদ ও দরগাহের জমি দখলের শুরু মাত্র। সঞ্জয় এই বিলের বিষয়ে আলোচনার জন্য দুই কক্ষের ৩১ সদস্যকে নিয়ে গঠিত যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) সদস্য ছিলেন।

সমালোচকেরা বলছেন, রাজ্য সরকার ১৯৮৫ সালের নথিপত্রকে অগ্রাহ্য করেছে। যেই নথি থেকে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে উজ্জেইনের ওই এলাকায় মুসলিম কবরস্থান ও ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। সেখানে প্রায় দুই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনাস তানভীর আল–জাজিরাকে বলেন, উজ্জেইনের ঘটনা ‘ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি নিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ভূমি দখলের জাতীয় উদ্বেগকে’ প্রতিফলিত করছে।

আনাস বলেন, ভারতে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির অব্যবস্থাপনা ও দখল দীর্ঘদিনের সমস্যা। প্রস্তাবিত ওয়াক্‌ফ (সংশোধন) বিল ২০২৪ এই সমস্যা আরও বাড়াবে।

তবে মধ্যপ্রদেশের ওয়াক্‌ফ বোর্ড চেয়ারম্যান সানাওয়ার প্যাটেল দাবি করেন, সরকারের আনা সংশোধনীর ফলে ‘বিদ্যমান সমস্যা এবং অনিয়ম দূর হবে’।

ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিতকরণ

সরকারের পরিকল্পিত সংশোধনীর কারণে মুসলিমদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে, সরকার ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি আরও ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনেক মুসলিম নেতা ও আইনজীবী বলছেন, বর্তমান আইনের অধীনেও ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি ব্যাপক হারে দখল করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা ইচ্ছাকৃতভাবে দখল, অব্যবস্থাপনা ও ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি পরিচালনায় সরকারের দুর্নীতির কয়েক দশকের চিত্র তুলে ধরছেন। তাঁরা অভিযোগ করছেন, জেলার রাজস্ব কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ পদ্ধতিগতভাবে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি ব্যাপকভাবে অবৈধ দখল ও ব্যক্তিমালিকানায় রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমির রেকর্ড ও খাজনা আদায়ের দায়িত্বে থাকা সরকারের রাজস্ব বিভাগ ওয়াক্‌ফর ভূমি ও সম্পত্তি অ–ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি বলে ঘোষণা দিয়ে আসছে।

১৯৬০ ও ১৯৮০–এর দশকে মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ড দুই দফায় তাদের সম্পত্তির জরিপ করেছিল। তখন দেখা গিয়েছিল, তাদের ২৩ হাজার সম্পত্তি রয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোতে সম্পত্তি ও ভূমি শনাক্ত করতে ডিজিটাল রেকর্ড ও জিওট্যাগ করেছিল তারা।

বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, সরকারের রাজস্ব কর্মকর্তারা মান্ধাতা আমলের ভূমি রেকর্ডস রাখছেন। বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতার আগের জরিপ। ১৯৫৪ সালে ওয়াক্‌ফ আইন হওয়ার পর ভূমি রেকর্ডে পরিবর্তন বাধ্যতামূলক করা হলেও ওয়াক্‌ফ বোর্ডের জরিপের ভিত্তিতে সেটা তারা করেনি। রাজস্ব বিভাগ ভূমি রেকর্ডের কিছুই হালনাগাদ করেনি। যেমন ১৯৮৫ সালের গেজেট অনুযায়ী উজ্জেইনে ওয়াক্‌ফর ১ হাজার ১৪টি সম্পত্তি ছিল। কিন্তু রাজস্ব বিভাগের রেকর্ডে একটিকেও ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করেনি রাজস্ব বিভাগ।  

উজ্জেইনভিত্তিক মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্টের আইনজীবী আশার ওয়ার্সি জনস্বার্থে একটি মামলা করেছিলেন। তিনি বলেন, ওয়াক্‌ফর ১ হাজার ১৪টি সম্পদের মধ্যে সরকারের মালিকানায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ৩৬৮টি, ব্যক্তিমালিকানায় ৪৫৪টি এবং ১৯২টি সম্পত্তির রেকর্ড হয় অসম্পন্ন, নয়তো রেকর্ডই নেই।

২০০০ সালের দিকে শুরু হওয়া ভূমির ডিজিটাল রেকর্ড সমস্যাকে আরও গভীরতর করেছে। কারণ, সফটওয়্যারে মাত্র দুটি কলাম রাখা হয়েছে—সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানা। ওয়াক্‌ফর মালিকানাধীন সম্পদ রাজস্ব কর্মকর্তারা সরকারি মালিকানার কলামে রেকর্ড করেছেন।  

ওয়াক্‌ফ সম্পদ পুনরুদ্ধার আন্দোলনে জড়িত মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা মাসুদ খান বলছিলেন, ‘এ কারণে ১৮৫৭ সালে নির্মিত মতি মসজিদ সরকারি সম্পত্তি হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এটা একেবারে অসম্ভব এক ব্যাপার।’

মাসুদ খান ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে মসজিদের রেকর্ড সংশোধন করার জন্য রাজস্ব বিভাগের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

আল–জাজিরা মধ্যপ্রদেশের রাজস্বমন্ত্রী করণ সিং ভার্মার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চায়, কেন সরকারি রেকর্ডে রাজস্ব বিভাগ রেকর্ডটি সংশোধন করেনি। তিনি জবাব দেন, ‘বিষয়টি অনেক পুরোনো, আমি এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’  

অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি

মুসলিমরা বলছেন, উজ্জেইনে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি সরকারি দখলে নিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটা মধ্যপ্রদেশ ও ভারতের অন্যান্য এলাকায় ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি নিয়ে যা হচ্ছে, তারই একটি নমুনামাত্র।

আদালতে করা ওয়ার্সির আবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও কর্মকর্তাদের নজরদারির মধ্যে ‘পদ্ধতিগতভাবে ও ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি লুট করা হচ্ছে’। এতে আরও বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কয়েক দফায় মধ্যপ্রদেশ সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব চিঠিতে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এই ইস্যুতে কোনো কথা ‘কানে নেয়নি’। বরং তারা ‘ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি’ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ওয়াক্‌ফ আইনে বিশেষজ্ঞ মেহমুদ প্রাচা আল–জাজিরাকে বলেন, ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির রেকর্ডে নানা অসংগতি ভারতজুড়ে খুবই সাধারণ বিষয়। এসব সম্পদ দখল ও লুণ্ঠন করা হচ্ছে।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে ভোপালে একটি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) ওয়াক্‌ফর ১ দশমিক ২ হেক্টর (২ দশমিক ৮৮ একর) জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ওই এনজিওর ট্রাস্টি আবার বিজেপি নেতা। অধিগ্রহণ করার ক্ষমতা দেওয়া ওই সম্পত্তি পড়েছে আবার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়। রাজ্য সরকারের রেকর্ডে ওই সম্পত্তি কবরস্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওই জমিতে আধা ডজনের মতো কবরও রয়েছে।

ভোপালের মতি মসজিদে মুসলিমদের নামাজ আদায়ের দৃশ্য। ওয়াক্‌ফ বোর্ডের মালিকানাধীন এই মসজিদের সম্পদ রাজস্ব বিভাগের রেকর্ডে সরকারের সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওয়াক্‌ফ বোর্ড ট্রাইব্যুনাল ও আদালত ওই সম্পত্তি অধিগ্রহণের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার আগেই এনজিওটি ২০২১ সালে সেখানে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে ফেলে। তারা সেখানে কমিউনিটি হল করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় কারফিউ জারি করে এবং প্রতিবাদ–বিক্ষোভ দমন করতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে।

মুসলিম সমাজকর্মী খান প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘ওয়াক্‌ফ আইন অনুযায়ী এমন সম্পত্তিতে অননুমোদিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে বা তা ভেঙে দিতে জেলা প্রশাসন ও সরকার বাধ্য। কিন্তু সরকারই সেখানে সম্পত্তি ও লুটের ঘটনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কে আইন সমুন্নত রাখবে?’

ওয়াক্‌ফ বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, ভোপাল, ইন্দোর এবং মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য শহরে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের শত শত সম্পত্তি রয়েছে। রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠোপোষকতায় বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে এসব সম্পত্তি দখল ও লুণ্ঠন করা হচ্ছে।  

ভারতে ওয়াক্‌ফ আইন প্রথম পাস করা হয় ১৯৫৪ সালে। সরকারের সহায়তা নিয়ে মুসলিমরা এই বোর্ড চালিয়ে আসছিল। ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে সেই আইন সংশোধন করে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। এমনকি ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যপ্রদেশ ওয়াক্‌ফ বোর্ডের এক সদস্য আল–জাজিরাকে বলেন, মধ্যপ্রদেশ পুলিশের বড় বড় ভবন, ভোপাল পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ স্টেশন এবং সরকারের অসংখ্য ভবন ওয়াক্‌ফর মূল্যবান জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজ্যের রাজধানী থেকে এক শ–এর বেশি কবরস্থান উধাও হয়ে গেছে। একসময় ১৪০টির বেশি কবরস্থান ছিল রাজধানীতে।

ওয়াক্‌ফ বোর্ডের নিয়োগ দেওয়া মোতোয়ালি ও তত্ত্বাবধায়কদের জালিয়াতির মাধ্যমে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তি বিক্রি বা সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে জড়িত থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ভূমি দখল, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা ওয়াক্‌ফ সম্পত্তিকে অরক্ষিত করে তুলেছে। তাঁরা বলছেন, নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার বৈধভাবে ওয়াক্‌ফর সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।

আইনজীবী মেহমুদ প্রাচা বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে সম্পত্তির দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। ভারতজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ওয়াক্‌ফ বোর্ডের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। এখন সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার একযোগে এসব সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।’