প্রধানমন্ত্রী মোদির চোখে ভয় দেখছেন রাহুল
লোকসভার সদস্য পদ খারিজ হওয়ার পরদিনেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী জানিয়ে দিলেন, শুরু থেকে তিনি যে প্রশ্ন করে চলেছেন, এখনো সেটাই করবেন। শিল্পপতি গৌতম আদানির গোষ্ঠীতে যে ২০ হাজার কোটি রুপি লগ্নি হয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? তাঁর সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কই–বা কী?
আজ শনিবার দুপুরে কংগ্রেস সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে রাহুল বলেন, লোকসভায় পরবর্তী ভাষণ তিনি যাতে দিতে না পারেন, সে জন্যই তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ও তাঁর ভাষণকে ভয় পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর চোখে তিনি ভয় দেখছেন।
রাহুল সংবাদ সম্মেলনে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার নাম সাভারকর (হিন্দুত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা) নয়। আমার নাম গান্ধী।’ তিনি বলেন, ‘আমার তোলা প্রশ্ন থেকে নিজেদের আড়াল করতে আমি যা বলিনি, বিজেপি তা–ই তুলে ধরে ক্ষমা চাইতে বলে মূল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে চাইছে।’
রাহুল বলেন, ‘এই গণতন্ত্রহীনতার কথাই আমি বলেছি। সে জন্যই আমার সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে। আমাকে জেলে পুরে দিলেও এই কথা বলে যাব।’
বিজেপির রাজনৈতিক ছক ঠিক কেমন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় রাহুল বলেন, মোদি–আদানি সম্পর্ক নিয়ে সংসদে তোলা সব প্রশ্ন কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁর এবং মল্লিকার্জুন খাড়গের ভাষণ দেখলে ওই সব অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি যাতে উত্তর না দিতে পারেন, সে জন্য বিদেশে না বলা কথা তুলে ধরে তাঁর ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে বিজেপি সরব হলো।
আদানি গোষ্ঠীতে ঢোকা ওই ২০ হাজার কোটি টাকা কার? সেখানে চীনেরও সংশ্রব রয়েছে। ওই টাকা ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে
রাহুল বলেন, ‘আমি গণতান্ত্রিক অধিকার পেতে স্পিকারকে দুটি চিঠি লিখেছিলাম। তিনি উত্তর দেননি। নিজে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলাম, আমাকে বলতে দেওয়া হোক। স্পিকার বলেন, তাঁর কিছু করার নেই। আমি যাতে কিছু না বলতে পারি, সে জন্যই সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়া হলো। এটাই আজকের ভারতের নতুন গণতন্ত্র!’
রাহুল বলেন, ‘লোকসভায় বলা একটি কথাও অতিরঞ্জিত ছিল না। প্রতিটি কথা তথ্য দিয়ে বলা। মোদি–আদানির সখ্য, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে ওঠা আদানিকে নিয়ে প্রশ্ন, অস্ট্রেলিয়ায় স্টেট ব্যাংকের চেয়ারপারসনের সঙ্গে ছবি—প্রতিটি তথ্যই নথিসহ রয়েছে। এসব চাপা দিতেই আমার বিরুদ্ধে বিজেপির মিথ্যাচার।’
কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, ‘এখনো আমার প্রশ্ন অতি সংক্ষিপ্ত। আদানি গোষ্ঠীতে ঢোকা ওই ২০ হাজার কোটি টাকা কার? সেখানে চীনেরও সংশ্রব রয়েছে। ওই টাকা ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
রাহুলের সদস্যপদ খারিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি প্রচার করছে, রাহুল অনগ্রসর সম্প্রদায়ের অসম্মান (মোদি পদবি গুজরাটে অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত) করেছেন।
বিজেপির এই প্রচারের জবাব দিতে গিয়ে রাহুল বলেন, ‘সাড়ে চার মাস ভারত জোড়ো যাত্রা করেছি। প্রতিটি মুহূর্তে সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলেছি। সম্প্রীতির প্রয়োজন অনুভূত করিয়েছি। প্রশ্নটি অনগ্রসরদের নিয়ে নয়, আদানিকে নিয়ে। আদানির বিরুদ্ধে কথা বলা বিজেপির কাছে দেশের বিরুদ্ধে বলা। ওরা বলছে, আদানি ও দেশ সমার্থক!’
আমাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে? আমি উজ্জীবিত
রাহুলের প্রশ্ন, ‘বুঝি না, বিজেপি কেন আদানিকে বাঁচাতে চাইছে। মানুষ জেনে গেছে, আদানি দুর্নীতিগ্রস্ত। অথচ তাঁকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী মরিয়া।’
২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রচারে কর্ণাটকে রাহুল গান্ধী ‘মোদি’ পদবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দুর্নীতিগ্রস্ত পলাতক ললিত মোদি, নীরব মোদির নাম করে জানতে চেয়েছিলেন, চোরদের পদবি কেন মোদি হয়? এই মন্তব্যের জেরে রাহুলের বিরুদ্ধে গুজরাটের এক বিজেপি নেতা পূর্ণেশ মোদি মানহানির অভিযোগে মামলা করেন। ২৩ মার্চ সেই মামলায় রায়ে রাহুলের দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। রায় পড়ে শোনান সুরাটের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, পর দিন ২৪ মার্চ, লোকসভা সচিবালয় তাঁর সদস্যপদ খারিজ করে দেয়।
বিজেপি বলছে, রাহুলকে আইন সাজা দিয়েছে। কংগ্রেসের দাবি, গোটা পর্বটিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেমন রাজনৈতিক, কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ তা জানিয়ে বলেন, ২০১৯ সালে করা মামলা এত দিন ঠান্ডা ঘরে পড়েছিল। মামলার বাদীর আবেদনে গুজরাট হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করেছিলেন। ৭ ফেব্রুয়ারি রাহুল লোকসভায় তাঁর ভাষণে মোদি–আদানি প্রসঙ্গ তোলেন। পরদিন গোটা ভাষণের আপত্তিকর সব অংশ মুছে দেওয়া হয়।
জয়রাম রমেশ বলেন, রাহুলের সেই ভাষণের সাত দিনের মধ্যে সুরাটের নিম্ন আদালতে রাহুলের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’–এ চলে যায়। আবেদনকারী হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেন ১৬ ফেব্রুয়ারি। নতুন করে শুনানি শুরু হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৭ মার্চ শুনানি শেষ হয় কিন্তু বিচারক রায় স্থগিত রাখেন। ২৩ মার্চ শোনানো হয় রাহুলের দুই বছরের কারাদণ্ডের রায়। সিএএ–এনআরসি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্য ‘আপ ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে’ আউড়ে জয়রাম রমেশ বলেন, এগুলোর কোনোটাই কাকতালীয় নয়।
আদালতের রায় নিয়ে রাহুল আজ কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁকে সমর্থনের জন্য তিনি সব বিরোধী দল ও নেতাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, সরকার ভয় পেয়ে বিরোধীদের হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিরোধীরা সবাই একজোট হয়ে লড়াই করবে। রাহুলকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি চিন্তিত?’ জবাবে কংগ্রেস নেতা বলেন, ‘আমাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে? আমি উজ্জীবিত।’