সরকার পরিচালনায় মোদির দুর্বলতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে

নরেন্দ্র মোদিফাইল ছবি: এএফপি

ইচ্ছেমতো সরকার চালাতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদি। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে দাপট তিনি দেখিয়েছেন, তৃতীয় দফায় তা অনেকটাই ফিকে হয় গেছে। পদে পদে বাধা পেয়ে মোদিকে এখন পিছু হটতে হচ্ছে। গতকাল তাঁর পিছু হটার পঞ্চম বড় নজির সৃষ্টি হয়ে গেল।

সরকারের কাজে গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম ও উপসচিব পদে সরাসরি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বিরোধী ও শরিকদের চাপে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। গতকাল মোদি সরকারের কর্মীবর্গ দপ্তরের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (ইউপিএসসি) এক চিঠিতে ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করার নির্দেশ দেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, সংরক্ষণের নিয়ম মেনে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে।

কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাডারভিত্তিক নিয়োগ হয়ে থাকে পরীক্ষার মাধ্যমে। ইউপিএসসি সেই পরীক্ষার আয়োজক। তাতে সফল পরীক্ষার্থীরা আইএএস, আইপিএস, আইএফএসসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় পদে নিয়োগ পান। মোদি সরকার ওইভাবে নিয়োগের পাশাপাশি সরাসরি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউপিএসসির মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় বিভিন্ন পদে উপযুক্ত প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য। সরকারি ভাষ্যে এই নিয়োগ পদ্ধতিকে ‘ল্যাটারাল অ্যান্ট্রি’ বলা হচ্ছে।

সরকারের দাবি, এর ফলে বিভিন্ন পদে উপযুক্ত ও দক্ষ মানুষকে নিয়োগ করা যাবে। তাতে সরকারের কাজে গতি ও দক্ষতা বাড়বে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ যুগ্ম সচিব এবং ৩৫ উপসচিব ও অধিকর্তা নিয়োগের জন্য ইউপিএসসি বিজ্ঞাপন দেয়।

মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথম সরব হয় কংগ্রেস। লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিয়মের বাইরে গিয়ে আরএসএস ক্যাডারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করতে চাইছেন, তা করতে গিয়ে তিনি সংরক্ষণের নীতি লঙ্ঘন করছেন। রাহুলের সঙ্গে বিরোধিতায় স্বর মেলায় সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, তৃণমূল কংগ্রেস, বামপন্থী দলসহ অনেকে। এমনকি বিজেপির শরিক জেডিইউ ও লোক জনশক্তি পার্টিও সরব হয়।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ান বলেন, এই নীতিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটবে। প্রত্যেকেরই এক কথা, মোদি সরকার সংরক্ষণ প্রথা এড়িয়ে সরকারি পদে নিয়োগ দিতে চলেছে শুধু উচ্চবর্গীয় সমমনাদের। রাহুল তো সরাসরি জানিয়ে দেন, বিজেপির দলিত, তফসিল, আদিবাসী ও অনগ্রসর বিরোধী চরিত্রের প্রমাণ এই সিদ্ধান্ত। তিন রাজ্য ও জম্মু কাশ্মীর বিধানসভার ভোটের আগে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে অবশেষে মোদি সরকার সরে আসতে বাধ্য হলো।

মোদির তৃতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর পিছিয়ে আসার এটি পঞ্চম উদাহরণ। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, আগের দুবারের তুলনায় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এবার তিনি যথেষ্ট দুর্বল। এর আগে তিনি মাত্র একবার আইন পাস করেও তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশব্যাপী কৃষক বিক্ষোভ তাঁকে বাধ্য করেছিল তিন বিতর্কিত আইন ফিরিয়ে নিতে। তখন তিনি কোনো শরিকের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এখন প্রতি পদে তাঁকে ভাবতে হচ্ছে।

মোদির দুর্বলতার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় এবারের বাজেটে। দ্বিতীয় দফার রাজত্বে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারীকরণের পথে এগিয়েছিলেন। ব্যাংক–সংক্রান্ত আইনে সংশোধনের কথা জানিয়েছিলেন। সে সময় ব্যাংক কর্মীদের সংগঠনগুলোর বিরোধিতায় লোকসভার ভোটের আগে সরকার ঝুঁকি নেয়নি। ঠিক ছিল, তৃতীয় দফায় ‘চার শ পার’ হলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারীকরণ করে ফেলা হবে, সরকারের শেয়ার বা মালিকানা ৫১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে।

কিন্তু ২৪০ আসনে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। বাজেটে ব্যাংক আইনের সংশোধনী পেশ হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসরকারীকরণের পথে সরকার হাঁটেনি।

দ্বিতীয় পিছু হটা সম্পত্তি করে নিয়মের হেরফের ঘটানোর ক্ষেত্রে। পুরোনো নিয়েমের বদলে নতুন যে নিয়মের প্রস্তাব বাজেটে রাখা হয় তাতে দেখা যায়, সম্পত্তি বেচাকেনার ক্ষেত্রে সরকারের মুনাফা অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। যদিও সরকার দেখাতে চাইছে, লাভবান হচ্ছে ক্রেতা–বিক্রেতা। নানা মহলের আপত্তির ফলে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে অর্থমন্ত্রী পিছিয়ে এসেছেন।

তৃতীয় নমুনা ‘ব্রডকাস্ট বিল’। প্রবল সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়ে সম্প্রচার পরিষেবা (নিয়ন্ত্রণ) বিলের খসড়া সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে ওই খসড়া এনেছিল সরকার। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমে লাগাম পরানোই ওই বিলের উদ্দেশ্য। গত বছরের নভেম্বরে ওই খসড়া তৈরি করে সরকার জনসাধারণের অভিমত জানতে চেয়েছিল।

চতুর্থ উদাহরণ ওয়াকফ সংশোধনী বিল। মুসলমানদের ওয়াক্‌ফ সম্পত্তিতে অমুসলমানদের হস্তক্ষেপ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির গণতান্ত্রিককরণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ওই বিল উত্থাপন করে বর্ষাকালীন অধিবেশনে। সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র বিরোধিতার মুখে সরকারকে পড়তে হয়। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, এআইএমআইএম ছাড়া শরিক দল টিডিপি ও জেডিইউও বিরোধিতায় সরব হয়।

অভিযোগ, বিলটি অসাংবিধানিক ও তা মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী। সেই প্রবল বিরোধিতার মুখে বিল পেশ করেই কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুমন্ত্রী কিরেন রিজিজু তা আরও বিবেচনার জন্য সংসদের দুই কক্ষ নিয়ে গঠিত যুগ্ম সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই কমিটিতে বিজেপিরই সংখ্যাধিক্য। চেয়ারম্যানও তাঁদের। তবু সরকারকে বিল পুনর্বিচনার জন্য বাধ্য করা যেমন বিরোধীদের কৃতিত্ব, তেমনই তা মেনে নেওয়া সরকারের দুর্বলতারও পরিচয়।

গত ১০ বছরে মোদি সরকার মাত্র দুবার বিবেচনার জন্য দুটি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়েছিল। ২০১৬ সালে পাঠানো হয় জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বিল, ২০১৯ সালে তথ্য সুরক্ষা বিল। ওয়াক্‌ফ সংশোধিত বিলের খসড়ায় দুজন নারী ও দুজন অসুমলমানকে রাখা হয়েছে। বিরোধীদের প্রশ্ন, অন্য কোনো ধর্মের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ভিন ধর্মের কারও উপস্থিতি নেই। ওয়াক্‌ফ বোর্ডে তা হলে অন্য ধর্মের লোকজনের উপস্থিতি কেন?

কেন্দ্রীয় সরকারে ‘ল্যাটারাল অ্যান্ট্রির’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বিজেপি যে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেনি, তা স্পষ্ট। করলে জেডিইউ বা এলজেপির মতো শরিকেরা এভাবে বিরোধিতা করত না। বোঝা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি আগের মতো চলতে চাইলেও পারছেন না নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না থাকায়। ফলে সরকারের দুর্বলতাও বারবার প্রকট হচ্ছে।