দ্বিতীয় দফার ভোটে বিজেপির চিন্তা আরও বাড়ল
বিজেপির চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিল দ্বিতীয় দফার ভোট। সাত দিন আগে প্রথম দফার কম ভোটের হার বিজেপিকে বাধ্য করেছিল উন্নয়ন ও বিকশিত ভারতের আখ্যান শোনানোর বদলে ‘মুসলমান জুজুকে’ বড় করে তুলে ধরতে। কংগ্রেস ও মুসলমানদের সমার্থক প্রতিপন্ন করতে। মানুষের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মতো কাল্পনিক অভিপ্রায়ের গল্প শোনাতে। খোদ প্রধানমন্ত্রীই এসব বলে আসর গরম করেছিলেন। তবুও দ্বিতীয় দফার ভোটে মানুষ সাড়া দিল না। নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত হিসেবে দ্বিতীয় দফার ভোটের হার ৬৪। এই কেন্দ্রগুলোয় আগেরবার যা ছিল ৭০ শতাংশের কাছাকাছি।
বিজেপির চিন্তা আরও বাড়িয়েছে উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র। যোগী রাজ্যে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫৫ শতাংশের মতো, যা কিনা প্রথম দফার ভোটের চেয়েও ৬ শতাংশ কম। বিহারেও ভোট পড়েছে ৫৫ শতাংশ। মহারাষ্ট্রে আরও কম, সাড়ে ৫৪ শতাংশের মতো। মধ্যপ্রদেশে সামান্য বেশি, সাড়ে ৫৭ শতাংশ। কম ভোটের হার নিয়ে সব মহলেই বিশ্লেষণ চলছে। নানা কারণ উঠে এলেও সব পক্ষ এই বিষয়ে একমত যে, মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে এখনো তেমন একটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো হাওয়াই ওঠেনি।
হাওয়া যে নেই তা প্রথম দফার ভোটের হার দেখেই বোঝা গিয়েছিল। হাওয়া তুলতে, মানুষকে ভোট দিতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই আবেদন জানিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমে হরেক রকম বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোটদানের আবশ্যকতা বোঝাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। তবু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মানুষের মধ্যে সাড়া কম। কেন?
এই কেনর উত্তর হিসেবে উঠে আসছে নানা অভিমত ও ব্যাখ্যা। বিজেপির একাংশ মনে করছে, বেশি ভোট না পড়ার অর্থ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নেই, তা ছাড়া ভোটাররাও ধরে নিয়েছেন বিনা আয়াসে মোদিই জিতবেন। তাই কট্টর সমর্থকেরা ছাড়া অন্যরা ভোট দিতে যাচ্ছেন না। বিজেপির এই মহলের ধারণা, ভোটাররা হয়তো কিছুটা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। পরবর্তী পর্যায়গুলোয় সেটা কাটানো দরকার।
বিজেপির এই ব্যাখ্যা অতিসরলীকরণ বলে বিরোধী মহলের ধারণা। তারা মনে করছে, মোদিকে নিয়ে মানুষের উৎসাহ নিভে গেছে। সেই কারণে বিজেপির দুর্গ বলে পরিচিত কেন্দ্রগুলোতেও ভোটের হার নিম্নমুখী। নইলে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে এত কম ভোট পড়ত না। এই মহলের ব্যাখ্যা, বিরোধীদের চেয়েও জেতার তাগিদ বিজেপির বেশি। শাসক দলের অভ্যন্তরের অসন্তোষও কম ভোটদানের মধ্য দিয়ে প্রকট হচ্ছে। প্রথম দুই দফার ভোট আর যা–ই হোক বিজেপিকে একেবারেই আশান্বিত করে তোলেনি।
বিরোধী ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটাই যদি ‘ট্রেন্ড’ হয় তা হলে একক গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও বিজেপির পক্ষে ২০১৪ ও ২০১৯ এর সাফল্য ছোঁয়া সম্ভব হবে না। চার শ পার তো দূরের কথা। তাদের বিশ্বাস, সেই কারণে যেভাবে তারা প্রচার শুরু করেছিল সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে তারা এখন কংগ্রেসের মুসলমান প্রীতির কথা সাতকাহন করে তুলে ধরছে। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করছে। মুসলমান জুজু খাঁড়া করে হিন্দুদের জাগাতে চাইছে।
এই প্রচার শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। রাজস্থানের বাঁশবাড়া নির্বাচন কেন্দ্র থেকে। তারপর উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটকেও তিনি একই কথা বলেছেন। দ্বিতীয় দফার ভোট চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছে, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের চেনা ছক টেনে না আনলে হিন্দুত্ববাদী হাওয়া তোলা সম্ভবপর নয়। তাই মধ্যপ্রদেশের একাধিক জায়গায় গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘কংগ্রেসের ইশতেহারটা মন দিয়ে পড়ুন। দেখবেন তাতে লেখা আছে ওরা মুসলিম পার্সোনাল ল কায়েম করবে। তিন তালাক প্রথা চালু করবে। দেশে কি তা হলে শরিয়তি আইন চালু হবে? ওই আইনে দেশ চলবে? রাহুল বাবা তাই চান। তুষ্টিকরণের রাজনীতির জন্য তিনি সব করতে পারেন। কিন্তু বিজেপি তা কিছুতেই হতে দেবে না।’ শাহ বলেন, ‘আমরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সারা দেশে চালু করব। উত্তরাখন্ডে হয়েছে। বাকি রাজ্যেও হবে এবারের জয়ের পর।’
একই কথা একই সুর শোনা গেছে বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার গলাতেও। গতকাল তাঁর যে বক্তব্য বিজেপি ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে প্রচার করে তাতে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। ওই বিবৃতি রেকর্ড হয় মোদির ভাষণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ পাওয়ার পর। কমিশন কিন্তু নাড্ডার বিবৃতি আমলে নেয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, মুসলমান ভীতি জাগিয়ে হিন্দু ভোট সংগ্রহের চেষ্টাই বিজেপি পরবর্তী দফাগুলোতেও বড় করে তুলে ধরবে। উন্নয়ন, সোনালি ভবিষ্যৎ, মোদির কঠোর নেতৃত্ব সব চাপা পড়ে যাবে। প্রাধান্য পাবে না বিরোধীদের পরিবারবাদ, দুর্নীতি বা নীতিহীন রাজনীতি।
কিন্তু তাতেও বিজেপি খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারছে না। যে রাজ্যগুলো কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও মোদি মাহাত্ম্যে বিজেপির ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছিল, সেখানেও তারা চিন্তায় রয়েছে। যেমন রাজস্থান। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে এই রাজ্যের ২৫টি আসনের একটিও বিরোধীরা পায়নি। এবার সেখানে জাট ও রাজপুতদের ক্ষোভ তাদের তটস্থ রেখেছে। এই দুই সম্প্রদায়কে বিজেপির কাছে নিয়ে আসতে এতকাল সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন বসুন্ধরা রাজে। মোদি-শাহ তাঁকে উপেক্ষা করেছেন। ওই সিদ্ধান্ত জাট ও রাজপুতদের অসন্তুষ্ট করেছে। সেই অসন্তোষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পুরুষোত্তম রূপালা। গুজরাটের এই নেতা ও রাজ্যসভা সদস্য গত মার্চ মাসে এক দলিত সমাবেশে রাজপুত ও ক্ষত্রিয়দের সম্পর্কে বলেছিলেন, ওরা ব্রিটিশদের কাছে মাথা নুইয়েছে। তাদের ঘরে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে। সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কিন্তু দলিত সমাজ কখনো তা করেনি। অথচ দলিতেরাই সবচেয়ে নিপীড়িত।
রুপালা বারবার ক্ষমা চাওয়া সত্ত্বেও রাজস্থান ও গুজরাটের রাজপুত-ক্ষত্রিয়দের ক্ষোভ কমেনি। রাজস্থানের জাট-রাজপুত অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলোতে ভোট পড়েছে জাতীয় গড়ের কাছাকাছি। ৬৪ শতাংশ। এই বর্ধিত হার বিজেপির চিন্তা বাড়িয়েছে। মনে করা হচ্ছে, জাট-রাজপুতেরা জোটবদ্ধ হয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে।
এই আশঙ্কাতেই কি মোদি গুজরাটে দুই দিনে মোট ছয়টি জনসভার পাশাপাশি রোড শোয়ের পরিকল্পনা করেছেন? বিরোধীদের ধারণা তেমনই। রুপালার মন্তব্য গুজরাটের রাজকোট ও সৌরাষ্ট্র এলাকায় রাজপুত-ক্ষত্রিয়দের ক্ষুব্ধ রেখেছে। তা প্রশমন করতে না পারলে ২৬ আসনের মধ্যে সাত-আটটিতে বিজেপিকে অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে। রাজ্যের ২৬ আসনের একটিতেও বিজেপি গতবার হারেনি।
বিজেপি ও কংগ্রেসকে নির্বাচন কমিশনের নোটিশের জবাব দিতে হবে সোমবার। মোদির বক্তব্য কমিশন আপত্তিকর মনে করুক না করুক, কংগ্রেস ও মুসলমান নিয়ে তারা আক্রমণে রাশ টানবে না। বিরোধীরা মনে করে, ভোটে জিততে এই আখ্যানই তাদের একমাত্র হাতিয়ার।