মোদি কেন লোকসভা–বিধানসভা ভোট একসঙ্গে করতে চান
মুম্বাইয়ে বিজেপিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রথম দিনের বৈঠকের মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের ঘোষণা দেন সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি। ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশন কেন ডাকা হলো, কী বিষয় সেখানে জরুরিভিত্তিতে আলোচনা হবে—সে বিষয়ে সরকার একটি বাড়তি শব্দও উচ্চারণ করেনি। ফলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয়েছে নানারকম জল্পনা।
সেই রেশ থাকতে থাকতেই আজ শুক্রবার সকালে সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের এক খবর জল্পনার মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে পিটিআই জানায়, সারা দেশে একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন করানোর বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। কমিটির নেতৃত্ব দেবেন দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। আগামী বছর লোকসভা ভোটের সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোটও একসঙ্গে করে ফেলতে কেন্দ্রীয় সরকার আগ্রহী কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকলেও তার কারণ নির্দিষ্ট করেনি। আবার, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে সাবেক রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের নেতৃত্বে যে কমিটি গড়া হয়েছে, সেই ঘোষণাও সরকার দেয়নি। কমিটিতে আর কে কে রয়েছেন, তা–ও কারও জানা নেই। কিন্তু সেই কমিটি গড়ার খবর যে মিথ্যা সে কথাও সরকার বলছে না।
এরই মধ্যে বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা শুক্রবার সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু কেন সেই সাক্ষাৎ, সে বিষয়ে তিনিও কিছু বলেননি। সব মিলিয়ে ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে আচমকাই সৃষ্টি হয়েছে একটা বড় আগ্রহ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোন চমক দেখাতে চলেছেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা।
সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা ও কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের খবরের ‘সময়’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি সিদ্ধান্ত (একটি ঘোষিত অন্যটি অঘোষিত) এমন এক সময়ে গৃহীত হয়, যখন বিজেপিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট তাদের তৃতীয় সম্মেলন শুরু করেছে এবং জোটের বহর ২৬ থেকে বেড়ে ২৮ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই ‘সময়’–এর কারণেই বিশেষ অধিবেশনে মোদি কী করতে চলেছেন, তা রাজনৈতিক জল্পনা প্রাধান্য পায়। ইন্ডিয়ার বৈঠকেও একটা বড় অংশজুড়ে চলে বিষয়টি।
জোটের সম্মেলনে এমন সম্ভাবনার কথাও উঠে এসেছে, নানা দিক থেকে কোণঠাসা মোদি বিরোধীদের পালের বাতাস কাড়তে ২০২৪ সালের লোকসভার সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট করিয়ে ফেলতে পারেন। কিংবা লোকসভা ভোটের সময় এগিয়ে আনতে পারেন। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা–ই হোক, ইন্ডিয়া জোটের নেতারা সবাইকে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে তো বলেই দেন, সরকার ইডি, সিবিআইকে আরও সক্রিয় করে তুলবে। দুর্নীতির অভিযোগে বিরোধী নেতাদের কারাগারেও পুরতে পারে। সবাইকে সব ধরনের খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি মোটেও নতুন নয়। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের ভোট ওই নীতি মেনেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ওই নীতিতেই লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হয়ে এসেছে। কিন্তু রাজনীতি যত জটিল হয়েছে, দলের সংখ্যা বেড়েছে। দল ও সরকার ভাঙা–গড়ার প্রবণতা যত বেড়েছে, একদলীয় শাসনের জায়গা নিয়েছে বহুদলীয় জোট সরকার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ততই নড়বড়ে হয়েছে। জটিলতাও বেড়েছে। এ অবস্থায় নীতিগতভাবে ‘এক দেশ এক ভোট’ বাঞ্ছনীয় হলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। কাজেই মোদি সরকারের ইচ্ছা রামনাথ কোবিন্দ কতটা পূরণ করতে পারবেন সন্দেহ।
সরকারের যুক্তি, কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন একসঙ্গে হলে খরচ প্রচুর কমে যাবে। সময়, অর্থ, শক্তির অনর্থক অপচয় হবে না। বারবার ভোটের কারণে নির্বাচনী বিধি মানার ফলে কেন্দ্র ও রাজ্যের উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হবে না। নীতি আয়োগ, নির্বাচন কমিশন ও আইন কমিশন তাই এর পক্ষে। অটল বিহারি বাজপেয়ীর শাসনের সময় লালকৃষ্ণ আদভানিও এই নীতির পক্ষে সরব হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদিও এই তত্ত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
বিরোধীরা অবশ্য এর মধ্যে অন্যরকম ছক দেখতে চাইছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোট নেতারা মনে করেছেন, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে নরেন্দ্র মোদি দেশে প্রেসিডেন্ট ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছেন। বিরোধী নেতারা মনে করছেন, মোদি এটা চাইছেন একাধিক কারণে। প্রথমত, এর মধ্য দিয়ে বিরোধী জোট ভেঙে দেওয়া যাবে। বিরোধীরা লোকসভা ভোটে জোটবদ্ধ হলেও বিধানসভা ভোটে জোটবব্ধ থাকতে পারবেন না। সেখানে দলীয় স্বার্থের সংঘাত তীব্রতর হবে। তাতে বিজেপির লাভ।
দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থা জারির মাধ্যমে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় কমিশনের আওতায় আনা যাবে।
তবে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর করতে গেলে সংবিধান ও প্রচলিত আইনে অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো এ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে সর্বভারতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এত দ্রুত তা করা সম্ভবপরও নয়। কাজেই সংসদের বিশেষ অধিবেশন কেন ডাকা হলো, পাঁচ দিন ধরে সেখানে কী আলোচনা হবে, সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই।