মালদ্বীপ-ভারতের চিড় ধরা সম্পর্ক কি নতুন বছরে জোড়া লাগবে

নরেন্দ্র মোদি ও মোহামেদ মুইজ্জুএএফপি ফাইল ছবি

ভাঙনের সুর বাজছিল অনেক দিন ধরেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙনের রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। মালদ্বীপে ভারতবিরোধী হাওয়া ব্যাপকভাবে বইতে শুরু করে। চীন–ভারতের শক্তিমত্তার খেলায় মালদ্বীপ কোন দিকে ঝুঁকবে, দেশটির জনগণ ভোট দিয়ে তা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবল ভারতবিরোধিতা ও ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মুইজ্জু। এর আগে থেকেই ভারতবিরোধিতার হাওয়া বুঝে বেইজিং হাত বাড়িয়েই ছিল। দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বেইজিংয়ের বাড়ানো সে হাত ধরে নিতে দ্বিধা করেননি।

গত বছরের ওই নির্বাচনে ভারতপন্থী নেতা মোহাম্মদ সলিহ জয়ী হলে দ্বীপদেশটিতে নয়াদিল্লির প্রভাব বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পাশার দান উল্টে যায়। যার ফল দেখা শুরু হয় ২০২৪ সালের শুরু থেকেই। অবশ্য বছরের মাঝামাঝি থেকে আবার চিত্র বদলাতে থাকে।

মালদ্বীপকে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে মনে করা হয়। ভারত মহাসাগরের মাঝখানে একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্য দিয়ে যে জাহাজ চলাচলের রুট বা শিপিং লাইনগুলো আছে, তার মাঝামাঝি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। তাই দেশটিতে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে ভারত ও চীন প্রবল চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

মুইজ্জু চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো কর্মসূচি থেকে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নিতে আগ্রহী। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনও ছিলেন চীনঘেঁষা। তিনি মালদ্বীপে নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভারতকে প্রত্যাখ্যান করে চীনের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ইয়ামিনকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন ৬১ বছর বয়সী সলিহ।

অভিযোগ রয়েছে, ইয়ামিন দেশটিকে চীনা ঋণের ফাঁদে ঠেলে দিয়েছিলেন। ইয়ামিনের চীনঘেঁষা নীতি নয়াদিল্লিকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ভারত।

আরও পড়ুন

ভারত কৌশলগত জোট কোয়াডের সদস্য। চার সদস্যের এই জোটের অন্য তিন সদস্যদেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। ভারতের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রটির বেশির ভাগ মানুষ পছন্দ করেন না। অথচ সলিহর আমলে সেই প্রভাব অনেকটা বেড়ে যায়। তাই সলিহর বদলে মুইজ্জুকেই বেছে নেয় মালদ্বীপবাসী।

মুইজ্জু অবশ্য কূটনৈতিক দিক থেকে ভারসাম্য রেখে এগোতে চাইছেন। শুরুতে প্রবল ভারতবিরোধিতা দেখালেও পরে অবস্থান বদলেছেন তিনি। মালদ্বীপের উন্নতিতে মুইজ্জু চীনকে পাশে চান। পাশাপাশি ভারতবিরোধী জনমতকেও তিনি চটাতে চান না। কিন্তু ভারতবিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জিতেছেন বলে লক্ষ্য স্থির রাখতে চান। তাই, মুইজ্জু এমন কৌশলে এগোতে চাইছেন, যাতে কূটনৈতিক দিক থেকে তাঁর দেশ লাভবান হয়।

২০২৪ সাল জুড়ে ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কের নানা চড়াই–উতরাই দেখা গেছে। বছরের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে বাড়তে থাকা চিড় বছরের শেষের দিকে এসে আবার জোড়া লাগার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বছরের শুরুতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচার শুরু করেছিলেন এবং মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরিয়ে নিতে জোর দেখিয়েছিলেন। তবে বছরের শেষের দিকে এসে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিকঠাক করার দিকে আবার মনোযোগ দেন তিনি। ভারতের প্রভাব কমিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার যে নীতি শুরুতে তিনি দেখিয়েছিলেন, তা থেকে সরে আসেন তিনি।

আরও পড়ুন

একই সঙ্গে মালদ্বীপ বর্জন করে লাক্ষাদ্বীপে পর্যটক টানার ভারতীয় যে লক্ষ্য ছিল, সেটিও হালে পানি পায়নি। ভারতের পক্ষ থেকে মালদ্বীপকে হাতছাড়া করতে চায়নি। গত অক্টোবরে তাই মুইজ্জুকে নয়াদিল্লিতে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ভারতবিরোধিতার স্লোগানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মুইজ্জু প্রথামাফিক প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে না এসে বেছে নিয়েছিলেন তুরস্ক। তারপর তিনি যান চীন। এতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রথম বোঝা যায়। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকেও লাক্ষাদ্বীপকে পর্যটক টানার কৌশল হিসেবে জোর প্রচার শুরু হয়।

ভারতের এই বিষয়টি মুইজ্জুর প্রশাসনের লোকজন ভালোভাবে নেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাক্ষাদ্বীপ সফরে যাওয়ায় মালদ্বীপের দুই মন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। সেই মন্তব্য ঘিরে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়। ভারতীয় পর্যটকেরা যাতে মালদ্বীপ সফরে না যান, সে জন্য শুরু হয় ব্যাপক প্রচার। সেই প্রচারে ব্যাহত হয় মালদ্বীপের পর্যটনশিল্প। এই পরিস্থিতিতে কিছু ব্যবস্থা নেয় মুইজ্জু সরকার। দুই প্রতিমন্ত্রীকে প্রথমে বরখাস্ত করা হয়।

আরও পড়ুন

মে মাসেই চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিও সই করে মুইজ্জু সরকার। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে সই করা হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষার চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ছাড়া এপ্রিলে মুইজ্জু তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মালদ্বীপে অবস্থানরত ৮৮ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন। ভারত সেই দাবি মেনে সেনা সরিয়ে নেয়। যদিও তার আগে থেকেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তুলতে মুইজ্জু সচেষ্ট হন। কারণ, তিনি ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য চাইছিলেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য, প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু নানাভাবে তিক্ততার অবসানের কূটনৈতিক ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। ১০ মে শেষ দফার সেনা প্রত্যাহারের পর ভারতে আসেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির। জুনে তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথম দিল্লি আসেন মুইজ্জু। সেই সফরের ঠিক আগে বরখাস্ত দুই প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর আগস্টে মালদ্বীপ সফরে যান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

মালদ্বীপ সফরে গিয়ে ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে মালদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের উল্লেখ করে জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠই শুধু নয়, ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি অনুযায়ী মালদ্বীপের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন ভারতের অগ্রাধিকার।

বছরের শুরুতে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন ছিল, সে বরফ গলতে শুরু করেছিল আগে থেকেই। মুইজ্জুর সফর, মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, বিভিন্ন চুক্তি সই সম্পর্কের সেই আড়ষ্টতা বহুলাংশে কাটিয়ে দিয়েছে। এই সম্পর্ক নতুন করে কোন দিকে মোড় নেয়, সেদিকেই সবার চোখ থাকবে নতুন বছরে।

তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স

আরও পড়ুন