বড় দলগুলো যে কারণে ছিটকে পড়ল
>তথাকথিত ছোট দলগুলোর হাতে এবার বড়রা ভালো নাকানিচুবানি খেয়েছে। ভুলের খেসারতে বাদ পড়তে হয়েছে ফেবারিটদের। এই ব্যর্থতার কী কারণ?
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। নেইমার-কুতিনহো-মার্সেলোয় গড়া ব্রাজিল। এক দশক ধরে সুন্দর ফুটবল খেলা স্পেন, চ্যাম্পিয়ন জার্মানি—রাশিয়া বিশ্বকাপে এরা সবাই একই পথের যাত্রী। সেই পথ, বিদায়ের পথ। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা ইতালির অনুপস্থিতি দেখা গেল এই প্রথম। ইতালি তো এবার চূড়ান্ত পর্বেই উঠতে পারেনি। কিন্তু বাকি তিনটি বড় দলের বাদ পড়ার কারণ কী?
ব্রাজিল বরাবরের মতো এবারও ফেবারিট ছিল। বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন, নেইমার-কুতিনহোরা এবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন। কিন্তু শেষ আটের লড়াইয়ে তাঁদের ছিটকে ফেলেছে বেলজিয়াম। হ্যাজার্ড, ব্রুইনারা যেভাবে খেলেছেন, তাতে সবাই মুগ্ধ। গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার বীরত্বও মনে রাখার মতো। তবু ব্রাজিল পারল না কেন—এই প্রশ্নটা এসেই যায়।
বেলজিয়ামের সঙ্গে কাসেমিরোর অভাব হারে হারে টের পেয়েছে ব্রাজিল। তাঁর বিকল্প যে ফার্নান্দিনহো হতে পারে না, সেটা বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচেই প্রমাণিত। বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে চোটের কারণে দানি আলভেজের ছিটকে পড়াও বড় ধাক্কা ব্রাজিলের জন্য। দানিলো কিংবা ফ্যাগনার ব্যর্থ হয়েছেন আলভেজের অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে। অনেকে অবশ্য আলভেজের বিকল্প হিসেবে ফ্যাবিনহোর অন্তর্ভুক্তির আশা করছিলেন।
ব্রাজিল দলে সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা মধ্যমাঠ। তবে পাওলিনহোর সঙ্গে কাসেমিরো রসায়ন কাজে দিয়েছে বেশ। কিন্তু কাসেমিরোর নিষেধাজ্ঞার সুযোগটা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে রবার্তো মার্তিনেজের শিষ্যরা। হ্যাজার্ড আর লুকাকুকে দুদিকে খেলিয়ে মধ্যমাঠ নিজের দখলে রেখেছিলেন ডি ব্রুইনা একাই। আর তাতেই বিদায় ‘সেলেসাও’দের।
শুধু লিওনেল মেসির জন্য এবার বিশ্বকাপে অনেকে ফেবারিট ভেবেছিলেন আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু দলটির কোচ হোর্হে সাম্পাওলি শিষ্যদের গুছিয়ে নিতে পারেননি। বিশ্বকাপের আগে ১১ ও বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচসহ মোট ১৫ ম্যাচে আর্জেন্টিনার এই কোচ নিজের পছন্দের একাদশ ঠিক করতে পারেননি। প্রতি ম্যাচেই মাঠে নামিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন একাদশ।
পাওলো দিবালার মতো খেলোয়াড়কে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছেন সাম্পাওলি। মেসিনির্ভর দল বানানোর ভুলে তিনিও পা দিয়েছেন। গোলপোস্টের নিচে সার্জিও রোমেরোর অনুপস্থিতিও টের পেয়েছে আর্জেন্টিনা। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা কোচ আলেজান্দ্রো সাবেলা রক্ষণকে দিয়েছিলেন বিশেষ গুরুত্ব। আর এবার সাম্পাওলির আর্জেন্টিনা ৪ ম্যাচে ৯ গোল হজম করেছে। এরপর আর আশা থাকে!
গ্রুপ পর্বে পর্তুগাল, ইরান, মরক্কোর বিপক্ষে কোনো ম্যাচেই স্পেনকে স্বরূপে দেখা যায়নি। বিশ্বমানের স্ট্রাইকারের অভাব ভুগিয়েছে দলটিকে। আর ‘টিকিটাকা’র ওপর অতিনির্ভরতা খুব একটা কাজে দেয়নি। ১১১৪ পাস দিয়েও তারা রাশিয়া বিপক্ষে ম্যাচটা জিততে পারেনি। তবে স্পেনের ব্যর্থতার পেছনে দলের মধ্যে অস্থিরতাকে বিবেচনা করা হচ্ছে প্রধান কারণ হিসেবে। দেশের ফুটবল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বার্থজনিত কারণ প্রভাব ফেলেছে দলেও।
বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিদায় এবার সবচেয়ে বড় অঘটন। দলের খেলোয়াড়দের প্রতি বেশি সৎ থাকতে গিয়ে একাদশ নির্বাচনে ভুলের খেসারত দিয়েছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। মেক্সিকোর বিপক্ষে মনে হয়েছে, জার্মান দলটা বুড়ো হয়ে গেছে। খেদিরা-ওজিলের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাস, বোয়েটেংদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ জার্মানির বিদায় নিশ্চিত করে।
ছোট দলগুলো বেশ কিছু বিষয় বুঝে বড় দলগুলোর ভুলের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দলের ব্যাপারে প্রস্তুতিটা তারা আগেই সেরে রেখেছিল। আর কার কোথায় দুর্বলতা, সেটাও খুঁজে খুঁজে বের করেছে। বড় দলগুলো ধরেই নিয়েছিল, তাদের কোনো না কোনো তারকা জিতিয়ে মাঠ ছাড়বে, কিন্তু সে রকম কিছু আর ঘটেনি। অন্যদিকে ছোট দলগুলো খেলেছে কৌশল ঠিক করে। বড় দলগুলোর বিদায় নেওয়ার অন্যতম কারণ, প্রতিপক্ষ ফন্দি এঁটে মাঠে নামছে তা উপলব্ধি করতে না পারা।
ইরান কিন্তু স্পেনকে প্রায় আটকেই দিয়েছিল। মেক্সিকো এবার জার্মান দুর্গে যেভাবে প্রতি–আক্রমণ করেছে, লো তা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন, সে সুযোগ নেই। ব্রাজিলের সঙ্গেও ভালো খেলেছে মেক্সিকো। আইসল্যান্ডের রক্ষণ ভাঙতে পারেনি আর্জেন্টাইন আক্রমণ। ক্রোয়েশিয়াকে ছোট দল বলার সুযোগ নেই। কারণ, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা দল আর যা–ই হোক সামর্থ্যে ছোট হতে পারে না। বেলজিয়ামও ঠিক তাই। এ দুটি দলেই আছে সোনালি প্রজন্ম।
সব মিলিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগেছে বড় দলগুলো। এই দুর্বলতা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে ছোট দলগুলো। তাতে কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ‘ছোট দল’ ধারণাটার বিলুপ্তি ঘটেছে। কারণ, তথাকথিত বড় দলগুলো তো সব ছিটকে পড়েছে।