এক পাশে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া, কামিন্স

শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২৩। কেমন ছিল খেলার এই বছর? ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ ফিরে দেখা যাক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।

প্যাট কামিন্স একা দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত থেকে ট্রফিটা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়কের অপেক্ষা—সতীর্থরা বিজয়মঞ্চে এসে যোগ দেবেন শিরোপা-উদ্‌যাপনে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে নেমে অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে করমর্দন শুরু করেছেন, বিব্রতকর অবস্থাতেও মুখে একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে ওপাশে তাই একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে কামিন্সকে।

মোদির নামের স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ-উৎসবের সব আয়োজন সেরে রেখেছিল ভারত—মাঠে এবং মাঠের বাইরেও। সেসব ভেস্তে দিয়েছে কামিন্সের দল। আক্ষরিক অর্থেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যেমন গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন আফগান-রূপকথার আরেকটি স্বপ্ন-অধ্যায়, কদিন আগেও ভাঙা হাত নিয়ে পড়ে থাকা ট্রাভিস হেড এসে বনে গেছেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল আর ফাইনালের নায়ক, তেমনি কামিন্সদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি তখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে অপরাজিত, অদম্য ভারত।

২০২৩ সালে কামিন্স আর তাঁর দল হয়ে উঠেছিল ক্রিকেটের ‘সিরিয়াল উইনার’। সাফল্যের শতকরা হারের মানদণ্ডে অস্ট্রেলিয়া হয়তো শীর্ষে ছিল না, কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ‘মেগা পুরস্কার’-এর, তখন তারা একা দাঁড়িয়ে এক পাশে। ফাইনালের মঞ্চে কামিন্স যেমন ছিলেন।

২০২৩ সালে কামিন্স আর তাঁর দল হয়ে উঠেছিল ক্রিকেটের ‘সিরিয়াল উইনার’
রয়টার্স

***

২০১৯ সালে বিশ্বকাপ শিরোপা হাতছাড়া হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার, পেনাল্টির খড়্গে পড়ে ২০২১ সালে খেলা হয়নি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনাল। ক্রিকেটের পুরোনো দুই সংস্করণের চ্যাম্পিয়নশিপের ‘ডাবল’ই এবার নিয়ে গেছে তারা। ভারতের মাটিতে এবারও টেস্ট সিরিজ জয় অস্ট্রেলিয়ার অধরাই থেকে গেছে, কিন্তু ওভালে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ভারতের বৈশ্বিক ট্রফির খরা আরেকটু দীর্ঘায়িত করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদাটা ঠিকই নিয়েছে দলটি।

ওভালে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ভারতের বৈশ্বিক ট্রফির খরা আরেকটু দীর্ঘায়িত করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা ঠিক জিতেছে অস্ট্রেলিয়া
রয়টার্স
৪২
২০২৩ সালে ৪২টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছে রুয়ান্ডা, এক পঞ্জিকাবর্ষে কোনো দলের যা সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চ ছিল ভারতের, গত বছর তারা খেলেছিল ৪০টি। এ তালিকায় তিনে এ বছরই ৩৩টি ম্যাচ খেলা উগান্ডা। (২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত)

তবে ইংল্যান্ডের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার অর্জনের মাপকাঠি যেন একটিই—অ্যাশেজ। সেই সিরিজের প্রথম বলে জ্যাক ক্রলি যখন কামিন্সকে কাভার দিয়ে চার মারলেন, তাতেই যেন ইঙ্গিত ছিল—সিরিজটি হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ডের ‘আনস্টপেবল ফোর্সের’ সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ‘ইমমুভেবল অবজেক্ট’-এর লড়াই। মাঝে ওল্ড ট্রাফোর্ডে বেরসিক বৃষ্টির হানার পরও এজবাস্টন, লর্ডস, হেডিংলি আর ওভাল হয়ে উঠল ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাশেজ সিরিজের রঙ্গমঞ্চ। কখনো উসমান খাজা, কখনো কামিন্স-নাথান লায়ন, কখনো মার্ক উড তাতে হয়ে উঠেছেন নায়ক, আর শেষে গিয়ে রূপকথার বিদায় পেয়েছেন স্টুয়ার্ট ব্রড।

এ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন স্টুয়ার্ট ব্রড
রয়টার্স

শেষ পর্যন্ত সিরিজ জেতেনি কোনো দলই, হয়তো ওল্ড ট্রাফোর্ডে বৃষ্টি না এলে ফল আসতে পারত ইংল্যান্ডের দিকেই। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডে সিরিজ না জেতা অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ড্র করে অ্যাশেজ ধরে রাখার ব্যাপারে আপত্তি করবে না একেবারেই। তবে তখনো বাকি বিশ্বকাপ। যেখানে কামিন্স একেবারেই অনভিজ্ঞ এক অধিনায়ক, যেখানে অস্ট্রেলিয়া গেছে কার্যত একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে, যেখানে একসময় নিজেদের তারা আবিষ্কার করেছে পয়েন্ট তালিকার তলানিতে!

তবে যখন যেখানে প্রয়োজন, অস্ট্রেলিয়া ঠিকই বের করে এনেছে তাদের অস্ট্রেলীয় সত্তা, চ্যাম্পিয়নশিপ ডিএনএ নামের রহস্যময় কোনো এক ব্যাপারে ভর করে শিরোপা জিতে তারা সবাইকে আরেকবার মনে করিয়েছে—হওয়ার কথা ছিল তো এটিই! অস্ট্রেলিয়ার ডাবল উদ্‌যাপনের বিপরীতে ভারত পুড়েছে ডাবল হতাশায়—টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পর বিশ্বকাপ ফাইনালে হারতে হয়েছে তাদের।

***

মাইকেল আথারটনের কাছে ২০২৩ সালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক দুটি। এক. মেয়েদের আইপিএলের একটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামো গড়ে ওঠা, যাতে নারী ক্রিকেট অনেকটাই এগিয়ে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। আরেকটি হচ্ছে ছেলেদের ক্রিকেটের অনিঃশেষ সূচি। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক ও এখনকার ধারাভাষ্যকার-লেখকের মতে, ক্রিকেট নিজেই যেন নিজেকে গ্রাস করে ফেলছে।

২৭৯০
বক্সিং ডে (২৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত উসমান খাজা ২০২৩ সালে খেলেছেন ২৭৯০টি বল, যা এ বছর পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা দলের (২৭৭৪) চেয়ে বেশি।  

বিশ্বকাপের বছরে ওয়ানডে এবারই এক পঞ্জিকাবর্ষে দেখেছে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, যদিও তিন সংস্করণ মিলিয়ে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দলগুলো এবার খেলেছে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯২টি ম্যাচ। তবে মালগাড়ির মতো চলতে থাকা সূচিতে যে শুধুই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কথা বোঝাননি আথারটন, সেটি সহজেই বোধগম্য।

একের পর এক টি-টোয়েন্টি লিগ ক্রিকেট ক্যালেন্ডারকে ফাঁকা থাকতে দিচ্ছে না মোটেও। নিজেদের ঘরোয়া লিগে খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা তাই নিউজিল্যান্ডে টেস্ট সিরিজে পাঠাবে দ্বিতীয় সারির দল, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো থেকে ক্রিকেটারদের ধরে রাখতে ইসিবি তো এনেছে একাধিক বছরের কেন্দ্রীয় চুক্তির পদ্ধতিও। বছরের শেষে যেমন আফগানিস্তান শাস্তি দিয়েছে তিন ক্রিকেটারকে—যাঁরা থাকতে চাননি কেন্দ্রীয় চুক্তিতে। অন্যদিকে বিশ্বকাপে ভারতীয়দের হৃদয় ভেঙে আইপিএলে ফিরে রেকর্ড গড়া কোটিপতি হয়ে গেছেন কামিন্স আর মিচেল স্টার্করা।

ক্রিকেট অনিশ্চিত এক পথে এগোচ্ছে নিশ্চিতভাবেই।

***

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছাড়া বিশ্বকাপ, শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এবার দেখা গেছে সেটিই। বছরের শেষে এসে অবশ্য নিজেদের পুনর্গঠনের ফাঁদে পড়ে যাওয়া ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ক্যারিবীয়রা জানান দিয়েছে, চাইলে তাদের নিয়ে আবার একটু আশাবাদী হওয়াই যায়। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে উগান্ডা।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে উগান্ডা
টুইটার

এর বাইরে অবশ্য তেমন নতুন কিছু নেই। বিশ্বকাপের আরেকটি সেমিফাইনাল নিভৃতেই খেলে ফেলেছে নিউজিল্যান্ড, বছরের অন্যতম রোমাঞ্চকর দুটি টেস্ট জয় ছিল যাদের (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১ রান, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ বলে গিয়ে ২ উইকেটে)।

আরেকটি বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর কোচ-অধিনায়ক বদলে ফেলেছে পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কায় তো বদলে গেছে ক্রীড়ামন্ত্রীই। অবশ্য মাঝ দিয়ে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়েছে তারা। খেলার চেয়ে আলোচনা আর নাটক-বিতর্ক বেশি হয়েছে বাংলাদেশে, হঠাৎ আশার আলো দেখিয়ে আবারও বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে উধাও জিম্বাবুয়ে। আগের চার বছর মিলিয়ে ৩টি টেস্ট খেলা আইরিশরা এক বছরেই খেলে ফেলেছে ৪টি।

টাই
মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দেখা গেছে ১৩টি টাই ম্যাচ, এর ৩টিই এসেছে ২০২৩ সালে। এর মধ্যে দুটি করে টাই ম্যাচের অংশ ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।

হুট করেই আবার ডেভিড ওয়ার্নারের ওপর খেপে গেছেন মিচেল জনসন। উসমান খাজাকে কখনো জুতার লেখা মুছতে বলছে আইসিসি, কখনো কালো আর্মব্যান্ড পরায় ‘শাসন’ করে দিচ্ছে, কখনোবা বলছে ‘পায়রা শান্তির প্রতীক হলেও আমরা আপাতত এর বিপক্ষে’। নাছোড়বান্দা খাজা শেষ পর্যন্ত নেমেছে জুতায় দুই মেয়ের নাম লিখে—কিছু না বলেও অনেক কিছুই বলতে চাইছেন তিনি।

বছরের শেষে এসে নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি জিতে কত বছরের খরা কাটিয়েছে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়ায় বিস্মৃত জয়ের দেখা পেতে নেমেছে পাকিস্তান। আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতের সিরিজ জয়ের অপেক্ষা বেড়েছে আরও। ফি বছর বিশ্বকাপের নীতিতে নতুন বছরে আসছে আরেক সংস্করণের আরেকটি বিশ্বকাপ।

কোথায় যাচ্ছে, তা ঠিক নিশ্চিত না হলেও ক্রিকেট ছুটছে ঠিকই।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ব্যাট দিয়ে খেলার পর হাত দিয়ে বল ধরে মুশফিকুর রহিম হয়েছেন অধুনা-বিলুপ্ত ‘হ্যান্ডলড দ্য বল’, এখন যেটি অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড

সেই তিন আউট

অ্যালেক্স ক্যারির ক্যারিয়ারটাই নাকি বদলে গেছে ওই আউট করার পর। বল খেলা শেষে ক্রিজ ছেড়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো জনি বেয়ারস্টোকে স্টাম্পিং করে লর্ডসে প্রায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার, যে আউটের আলোচনা গড়িয়েছিল দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মাঝেও। বিশ্বকাপে আবার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে দেরি করে আসায় ‘সরি’ বলে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান, টাইম আউট নামে কিছু যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঘটে—প্রথমবার দেখা গেছে সেটি। মুশফিকুর রহিম অবশ্য যা করার একাই করেছেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ব্যাট দিয়ে খেলার পর হাত দিয়ে বল ধরে হয়েছেন অধুনা-বিলুপ্ত ‘হ্যান্ডলড দ্য বল’, এখন যেটি অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড।

গত নভেম্বরে ৩১ বছর বয়সেই অবসরের ঘোষণা দেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক মেগ ল্যানিং
আইসিসি

ল্যানিংয়ের অবসর

‘অপ্রকাশিত’ এক অসুখে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বাইরে ছিলেন। এরপর গত নভেম্বরে ৩১ বছর বয়সেই অবসরের ঘোষণা দেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক মেগ ল্যানিং। মেয়েদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শতক, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবচেয়ে বেশি রান—ব্যক্তিগত অর্জনে ল্যানিং ছিলেন দুর্দান্ত। তবে অধিনায়ক ল্যানিংয়ের অর্জন একেবারেই অনন্য। টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে মিলিয়ে অধিনায়ক হিসেবে তিনি জিতেছেন ৫টি বিশ্বকাপ, পুরুষ ও নারী মিলিয়ে আর কোনো অধিনায়কের দুটির বেশি শিরোপাই নেই। অধিনায়ক হিসেবে টানা ২৪টি ওয়ানডে জেতার রেকর্ডও তাঁর। ল্যানিংয়ের পর পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব নেন অ্যালিসা হিলি, অবশ্য ভারতের কাছে প্রথমবারের মতো টেস্ট হারে অস্ট্রেলিয়া। ভারতে টেস্ট হেরেছে ইংল্যান্ডও।