২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নেতাদের নানামুখী তৎপরতা ঠেকাতেই ব্যস্ত বিএনপি

হঠাৎ দলের একাংশ ‘পেশাজীবী সমাজের’ ব্যানারে সমাবেশ করে সরকার পতনের ডাক দিয়েছে। এ নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘পেশাজীবী সমাবেশ’ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আবারও নড়চড় শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত রোববারের ওই সমাবেশে যাতে দলের কেউ না যান, সে জন্য আগের রাত থেকেই তৎপর ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। অনেককে ফোন করে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ নিজে থেকেই যাননি।

‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির’ দাবিতে গত রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ সমাবেশ হয়। ‘পেশাজীবী সমাজের’ ব্যানারে এই সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ডাক দেন আয়োজক শওকত মাহমুদ। রাজনীতিবিদেরা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে পেশাজীবীরা গণ-অভ্যুত্থানের দায়িত্ব নেবেন বলে বক্তব্য দেন তিনি। শিগগিরই পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন জানিয়ে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানান।

বিএনপির নেতারা বলছেন, পেশাজীবী সমাজের ব্যানারে রোববারের ওই সমাবেশের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, বরং দলের নীতিনির্ধারকদের অজান্তে এ ধরনের কর্মসূচির আয়োজন এবং সরকার পতনের ডাক দেওয়া নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, দলকে ভাঙা এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভাজন বাড়াতে অনেক দিন ধরে একটি মহল সক্রিয় রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ওই মহল আবারও তৎপর হয়েছে। এই তৎপরতায় এমন কোনো মহলের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য সরকারের উদ্দেশ্য হাসিল। এই সন্দেহ থেকে রোববারের সমাবেশে অংশ নিতে পারেন, এমন সম্ভাব্য নেতাদের ফোন করে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে।

■ বিএনপি মনে করছে, অবিশ্বাস ও বিভাজন বাড়াতে একটি মহল সক্রিয়। ■ হঠাৎ সরকার পতনের ডাক দিয়ে সমাবেশ করাকে ‘চক্রান্ত’ বলছেন গয়েশ্বর। ■ ‘জাতীয় সরকার’ নিয়ে আলোচনা ঠেকাতে নতুন কৌশল বিএনপির।

এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের অনেকে মন্তব্য করতে রাজি হননি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেছেন, পেশাজীবী সমাজের নামে করা ওই সমাবেশের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির মূল নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে দলে এবং জোটে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এতে নানা কারণে ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতাদের যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। তাঁদের নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। দল ও জোটের এমন অন্তত ৪০ জন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে বৈঠক হয় এই মহলের সঙ্গে। ২০১৯ সাল থেকে ওই তৎপরতা শুরু হয়। সর্বশেষ গত মাসেও দেশের বাইরে এমন বৈঠক হয় বলে জানা গেছে।

২০২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা এর আগে কোনো প্রেক্ষাপট তৈরির পরিকল্পনা থেকে বিশেষ কোনো মহল এই তৎপরতায় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বলে বিএনপির নেতাদের ধারণা। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভেতরে কানাঘুষা আছে। সরকার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই তৎপরতায় শুরুতে বিএনপির কেউ কেউ আগ্রহী ছিলেন, পরে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হওয়ায় অনেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তথ্য আছে, বিএনপিকে বাইরে রেখে ‘ক্ষমতার পটপরিবর্তন’ হতে পারে—কোনো কোনো মহলের এমন আশ্বাসে দলের অনেকে নানামুখী তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন। সরকার পতনের ডাক দিয়ে হঠাৎ রাস্তায় জমায়েত—এমন তৎপরতারই অংশ বলে সন্দেহ করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি রাজপথে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, হঠাৎ রাস্তায় সরকার পতনের ডাক দিয়ে এ ধরনের তৎপরতা ঐক্য প্রক্রিয়াকে বিভক্ত ও বিনষ্ট করার একটি চক্রান্ত।’

এর আগে ২০১৯ ও ২০২০ সালের ডিসেম্বরেও ঢাকায় এ ধরনের দুটি বড় জমায়েত করে রাস্তায় নেমেছিল জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও পেশাজীবী পরিষদ। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সামনের বিক্ষোভে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানানো হয়। পরের বছরের ১৩ ডিসেম্বর ‘সরকারের পতনের’ লক্ষ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও জমায়েত করা হয়। ওই দুটি কর্মসূচিতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, শওকত মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ছিলেন। দুটি কর্মসূচিতেই হঠাৎ রাস্তা অবরোধ করে কয়েক হাজার লোক বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সংগঠকেরা তখন নেতা-কর্মীদের ধারণা দিয়েছিলেন যে এই বিক্ষোভে বিভিন্ন দিক থেকে লাখো মানুষ এসে যুক্ত হবে। সেখান থেকেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা হবে। যার জের ধরে ‘দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ এনে হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

অবশ্য রোববারের সমাবেশে হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, ইশতিয়াক আজিজ ছিলেন না। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতাকেও দেখা যায়নি। তবে লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর অংশগ্রহণ অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে।

ওই সমাবেশে যুবদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এলবার্ট ডি কস্তা বেশ সক্রিয় ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার পতনের ডাক যে-ই দিক, সেটাকে আমি সমর্থন করি। বাম দলগুলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে হরতাল করেছে, আমরা কী করেছি? এর জবাব কী। আমার মনে হয়, যারা এ ধরনের কর্মসূচি সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়, তারা মূলত আওয়ামী লীগেরই পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য হাসিল) করছে।’

এই সমাবেশে লোকজন জড়ো করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে শওকত মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে কোর্টে আমার দেখা হয়। সেখানে তিনি আমাকে সমাবেশের দাওয়াত দেন। বলেছেন, তাঁর বড় সমাবেশ আছে। আমাকে সরকারবিরোধী যে কর্মসূচিতেই দাওয়াত দেওয়া হয়, আমি সেটাতেই যাই।’ তিনি বলেন, ‘আয়োজকদের আসল উদ্দেশ্য কী, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমি এখনো অন্ধকারে আছি। সমাবেশে নেতিবাচক কিছু আমার চোখে পড়েনি।’

রোববারের সমাবেশের মূল উদ্যোক্তা শওকত মাহমুদ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক। কিন্তু রোববারের সমাবেশে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। শওকত মাহমুদ বেশ কয়েকজন পেশাজীবী নেতাকে সমাবেশে যোগ দিতে ফোন করেছিলেন, কিন্তু কেউ যাননি।

তবে শওকত মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পেশাজীবীরা গণ-অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে চান, চূড়ান্ত আন্দোলন বিএনপির নেতৃত্বেই হবে। এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

‘তাহলে আপনাদের তৎপরতা নিয়ে বিএনপির ভেতরে সন্দেহ কেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে শওকত মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের নিয়ে কারও সংশয়-সন্দেহ থাকতে পারে; সেটা হয় ঈর্ষান্বিত হয়ে হতে পারে। আবার কেউ মনে করতে পারেন, আন্দোলন না করে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। সেই চিন্তার সঙ্গেই আমাদের বিরোধ।’

এদিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মহলে নতুন করে ‘জাতীয় সরকার’ ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এতে জোটের শরিক ও সমমনা কয়েকটি দলের পাশাপাশি বিএনপির নেতাদের একটি অংশও উৎসাহী। এ অবস্থায় কৌশলগত কারণে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বলছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পর যারা আন্দোলন করেছে, তাদের নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই।’