প্রধানমন্ত্রীও স্বেচ্ছাচারী হবেন না, এটা নিশ্চিত করতে চাই: তারেক রহমান
আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবে না—এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি স্তরে নিশ্চিত করা হবে যে কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে, আমরা দলমত–নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে চাই।’
রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে বিএনপির রূপরেখার ৩১ দফা নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তারেক রহমান এ প্রতিশ্রুতির কথা জানান। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের লোক শোর হোটেলে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। লন্ডন থেকে সেমিনারে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন তারেক রহমান। সেমিনারে ঢাকায় নিযুক্ত ৩৮ দেশ ও সংস্থার দূত, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে একজন আলোচক স্মরণ করিয়ে দেন, সংস্কারের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে জনগণের কাছে বরখেলাপকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে বিএনপি দলমত–নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে কাউকে হেনস্তা করা হবে না। সত্য গোপন করতে মেইনস্ট্রিম (মূলধারা) ও সোশ্যাল মিডিয়া (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) যেমন বাধ্য থাকবে না, তেমনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেটির প্রচারেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না।’
তবে এ ক্ষেত্রে দেশ গঠনে গণমাধ্যমের কাছে বিএনপি নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে বলে জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তারেক রহমান আরও বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে কেবল একটি দল থেকে অন্য দলের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর নয়; বরং ক্ষমতার পালাবদলে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হওয়া উচিত, যেখানে সমাজের পরিবর্তিত অবস্থা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। ফ্যাসিবাদের পতনের পর গত তিন মাসে বিএনপির জাতীয় নেতারা এমন অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যাতে রাজনীতিতে আধুনিকায়নের উন্মেষ ঘটে। সেই সব উদ্যোগকে তারুণ্যের উদ্দীপনায় দেশজুড়ে প্রতিপালন করেছে বিএনপির তৃণমূল।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে তারেক রহমান বলেন, ‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সীমাহীন খুন, হামলা, ধর্ষণ, ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও দলীয়ভাবে তাদের শাস্তি দেওয়ার ইতিহাস নেই। দেড় হাজারের অধিক গণতন্ত্রকামী মানুষকে গণ-অভ্যুত্থানে হত্যা করার পরও আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কোনো অনুশোচনা নেই।’ তিনি বলেন, বিএনপির ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রয়েছে। তারপরও বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো অপরাধে জড়িত হলে তা জানামাত্রই দ্রুত সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দেশে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই বিএনপির ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝি যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য নয়; বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।’
সেমিনারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সভাপতিত্ব করেন। তিনি সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের জীবন—সবকিছুর কিন্তু পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনটা অনেক বেশি। বাংলাদেশের রাজনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য রাজনৈতিক কাঠামোর কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন।
বিএনপির উদ্দেশে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেবেন না, যেটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।’ বিএনপি যে এখন যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইছে, সেটা একেবারেই যৌক্তিক ও সঠিক বলে মনে করেন মান্না।
রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাবের জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনে আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা বিএনপির ওপর ভরসা রাখি। ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন না করলে আমরা জনগণের কাছে বরখেলাপকারী হিসেবে চিহ্নিত হব।’
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, এখন বাংলাদেশের বড় সমস্যা হচ্ছে, বিগত ১৬ বছরে যারা দেশ শাসন করেছে, তারা বাংলাদেশের তাবৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে গেছে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নেওয়া সংস্কারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে, এমন কোনো সংস্কার হতে পারে না।
এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে এর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক বিতর্কের প্রয়োজন। এতে রাজনৈতিক দলের সংস্কারও যুক্ত হওয়া দরকার।
সেমিনারে ৩১ দফার সংস্কার প্রস্তাবের ওপর আলোকপাত করেন সাবেক সচিব ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ। এই সংস্কার প্রস্তাবের ওপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদি আমিন ও বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর। আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন ও আইনজীবী এলিনা খান।
এ সময় মঞ্চে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহ উদ্দিন আহমদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।