করোনা: কিন্তু মন সামলাবেন কীভাবে?
করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ও কঠিন অভিজ্ঞতা। বিষয়টির নতুনত্ব, ভয়াবহতা, আগ্রাসন, সমগ্র বিশ্বের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিহ্বল করে ফেলেছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণ মূলত শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করলেও আমরা অজান্তেই পড়ে যাচ্ছি মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি
যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা নেতিবাচক ঘটনা ব্যক্তির মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে আমাদের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থাকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করছে। তবে ব্যক্তিবিশেষে এর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিত্বের গঠনের ওপর এর মানসিক প্রতিক্রিয়া একেক রকম।
মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোনো চাপযুক্ত ঘটনায় ‘উদ্বেগ’ কেবল স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই নয়, বরং প্রয়োজনীয়। স্বাভাবিক মাত্রার উদ্বেগে মস্তিষ্ক আমাদের সচেতন ও সজাগ করে এবং আসন্ন বিপদ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রণোদনা দেয়। সুতরাং কোভিড-১৯-এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আমরা সাধারণ জনগোষ্ঠী অনেকেই উদ্বিগ্ন হচ্ছি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই উদ্বেগ একরকম মানিয়ে নিয়ে সময়টা পার করছি।
কিন্তু এর মধ্যে আবার কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বিষয়টিকে একবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। অবচেতনভাবেই তারা একরকম অস্বীকৃতির মধ্যে আছেন অথবা নিজেদের তৈরি করা যুক্তিতে যেমন, ‘আমার হবে না’ বা ‘আমাদের এ ভাইরাস কোনো ক্ষতি করবে না’, ‘সৎ জীবন যাপন করি তাই কিছু হবে না’ ইত্যাদি ভাবনায় নিজেকে সুরক্ষিত ভাবছেন। তবে এ ধরনের মানসিক অবস্থায় যদিও ব্যক্তি আপাতভাবে নির্ভার থাকেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে এ ধরনের মনোভাব ব্যক্তির নিজের এবং তার কমিউনিটির জন্য ক্ষতিকারক।
উদ্বেগ আসলে তখনই ক্ষতিকারক, যখন সেটা মাত্রাতিরিক্ত হয় এবং আতঙ্কের পর্যায়ে চলে যায়। যেকোনো চাপে মস্তিষ্ক আমাদের শরীর থেকে কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ যেমন: এপিনেফ্রিন, নর-এপিনেফ্রিন এবং দীর্ঘ মেয়াদে কর্টিসল নিঃসরণ করে। এগুলো আমাদের শরীরের ভেতরের অর্গান সিস্টেমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এবং শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ তৈরি করে। ফলে চাপে আমাদের বুক ধড়ফড়, ঘাম দেওয়া, মুখ শুকিয়ে আসা, শ্বাস নিতে কষ্ট, মাথা ঘোরানো, মাথাব্যথা, পেটে সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। চাপ অতিরিক্ত হলে এসব উপসর্গ তীব্রভাবে অনুভূত হয়। দীর্ঘ মেয়াদে অতিরিক্ত চাপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নষ্ট করে। শারীরিক উপসর্গের সঙ্গে সঙ্গে নানা মানসিক উপসর্গ, যেমন: খিটখিটে মেজাজ, অস্থিরতা, নেতিবাচক চিন্তা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। এ ছাড়া আতঙ্ক বা অতিরিক্ত উদ্বেগ থাকলে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হয়।
কীভাবে মানসিক চাপ মোকাবিলা করবেন
এখন প্রশ্ন আসে এই কোভিড-১৯ আমাদের মনে যে ভয় সঞ্চার করেছে, সেটা আমরা মোকাবিলা করব কীভাবে? সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহবন্দী এই নতুন জীবন এবং এর কারণে আমাদের মানসিক চাপ আমরা সামলাব কীভাবে? মৃত্যু-আতঙ্ক, বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে যখন যুক্ত ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, তখন সে দুশ্চিন্তা থেকে কীভাবে সামলে নেব আমরা?
১. সম্মিলিত প্রচেষ্টায়: প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে কঠিন সমস্যা আমরা পার করছি, সেখানে আমরা একা নই। ব্যক্তি, পরিবার, কমিউনিটি, দেশ এবং সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষ আজ একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন, ভীত ও অনিশ্চয়তায় নিপতিত। কাজেই এই সমস্যার মোকাবিলাও হবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আমার একার ভালো থাকা বা নিরাপত্তা কোনোমতেই সুরক্ষা দেবে না আমাকে। যতক্ষণ না নিশ্চিত হবে আমার পাশের মানুষের নিরাপত্তা, আমার কমিউনিটির প্রতিটি মানুষের সুরক্ষা, রাষ্ট্র তথা সব বিশ্বের মানুষের ভালো থাকা, ততক্ষণ আমিও নিরাপদ নই। সুতরাং এই যুদ্ধে, এই কঠিন সময় মোকাবিলায় নিজেকে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি অন্যের ভালো থাকার বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে সবার আগে। সুতরাং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিজের প্রয়োজনের বেশি জীবাণুরোধক বা চাল, ডাল মজুত করলে বাজারে অন্যের জন্য যে সংকট তৈরি হবে, সেটার বিরূপ প্রভাব আমার গায়ে এসেও লাগবে।
গুজব নয়, সঠিক তথ্য জানুন: কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের ভয়ের অন্যতম কারণ এই নতুন ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা বা অপ্রতুল তথ্য। যে বিষয় সম্পর্কে আমরা যত কম জানি, সে বিষয়ই আমাদের মনে তত অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এই অনিশ্চয়তার হাত ধরেই আসে উদ্বেগ, আশঙ্কা, ভয়, আতঙ্ক। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো ‘সঠিক তথ্য জানুন, গুজব না ভুল তথ্য না’। সঠিক তথ্য আমাদের যেমন সঠিক পথ দেখায়, তেমনি গুজব বা ভুল তথ্য আমাদের বিভ্রান্ত করবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যান। করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা ওয়াকিবহাল থাকব, আপডেটেড থাকব কিন্তু খেয়াল রাখব এ বিষয়ে নিয়ে যেন সারা দিন পড়ে না থাকি। আমরা প্রতিদিন যেকোনো দুটি বা একটি সময় নির্দিষ্ট করব এ বিষয়ে তথ্য জানার জন্য।
শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন, মানসিকভাবে কাছে থাকুন: ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের শুধু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে, মানসিক দূরত্বের কথা বলা হয়নি। ফোনে, মেসেজে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের খোঁজ নিই, অন্যের প্রতি আমাদের উদ্বেগ আমরা প্রকাশ করি, কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাই। যতটুকু সম্ভব অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াই। অন্যের প্রতি আপনার মমতা যে আরেকজনের মনে শক্তি জোগাবে তাই না, এ ধরনের আচরণ আপনারও নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের দৃঢ় সংযোগ আমাদের মধ্যে যে সাহস জোগায়, নিরাপত্তাবোধ দেয়, যেকোনো সমস্যা মোকাবিলায় এর কোনো তুলনা নেই।
পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটান, নিজেকে যথাসম্ভব উৎপাদনশীল রাখুন: এই সময়টাতে অস্থির না হয়ে পরিবারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সময় কাটানোর একটি সুযোগ হিসেবে নিন। সময়ের অভাবে যে কাজগুলো অনেক দিন করা হচ্ছিল না, সেগুলো করুন। সম্ভব হলে বাগান করুন, গান শুনুন, সিনেমা দেখুন, ঘরের সাজসজ্জা বদলান, ঘরে হালকা ব্যায়াম, মেডিটেশন করুন। এসব কিছুই আপনাকে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া মানসিক শক্তি আপনার রোগ প্রতিরোধেও দারুণ সাহায্য করে।
এ কঠিন সংকট মেনে নিন, ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন: যেকোনো সংকট বা কঠিন সময়ের মানসিক চাপ সামলানোর প্রথম পদক্ষেপ হলো বিষয়টিকে উপেক্ষা বা এড়িয়ে না গিয়ে সমস্যাটি গ্রহণ করা এবং নিজের যতটুকু সাধ্য সে অনুযায়ী বিষয়টিকে মোকাবিলা করা। (ঘরে থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, বারবার হাত ধোয়া ইত্যাদি)।
আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, যতই খারাপ সময়ের মধ্যে আমরা যাই না কেন, জীবনের কোনো কিছুই যেমন চিরস্থায়ী না, এই সময়ও একসময় না একসময় শেষ হবে।
জীবনের কোনো কিছুই এককভাবে সম্পূর্ণ নেতিবাচক না। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে জীবন অনেক সময় আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয় সত্যি, কিন্তু আমাদের জীবন একই সঙ্গে আমাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়। সামনের চলার পথ সব সময়ই খোলা থাকে।
ডা. মেখলা সরকার: মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, ঢাকা