২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গুজরাটের নির্বাচনের ফল যে বিতর্ক উসকে দিতে পারে

ভারতের গুজরাট রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলা হচ্ছে কারণ এই রাজ্যে এত বেশিসংখ্যক আসন আর কোনো দল কখনো পায়নি।
ছবি: এএফপি

পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় পেল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এ জয় ঐতিহাসিক, কারণ ১৯৬২ সালে গুজরাট রাজ্যে প্রথম নির্বাচনের পরে এত বেশিসংখ্যক আসন আর কোনো দল পায়নি। তাৎপর্যপূর্ণভাবে নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০০২ দাঙ্গার স্মৃতি ফিরিয়ে এনে মনে করিয়ে দেন ‘তাদের’ অর্থাৎ মুসলমান সমাজকে সে সময় ‘উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল।’

গুজরাটের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা এই প্রতিবেদককে বলেন, এটা একটা নতুন ঘটনা। কারণ, ২০ বছর আগের ওই দাঙ্গার পরে বিজেপি বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনের আগে শীর্ষ স্তরে আর কোনো কথা বলেনি। দাঙ্গা নিয়ে তাদের অবস্থানও স্পষ্ট করেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনের আগে তারা তা করেছে।

পর্যবেক্ষকেরা বলেন, গুজরাট নির্বাচনের আগে মেরুকরণের প্রক্রিয়াকে সচল রাখতেই এটা করা হয়েছে। গুজরাট নির্বাচনের আগে মেরুকরণের এই প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও একটি মন্তব্য করেন, যার প্রভাব শুধু গুজরাটে সীমাবদ্ধ নয়।

আরও পড়ুন

এই মন্তব্যের অর্থ এবং প্রভাব আরও অনেক বিস্তৃত এবং গভীর বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন। এর লক্ষ্য শুধু গুজরাট নির্বাচন নয়, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। এই মন্তব্যের প্রভাব আরও অনেক ভয়াবহ হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

গত ২২ নভেম্বর একটি ইংরেজি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অমিত শাহকে প্রশ্ন করা হয় ১৯৯১ সালের একটি আইন নিয়ে। এই আইনটির নাম হলো ‘প্লেসেস অব ওয়র্শিপ অ্যাক্ট’। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের এক বছর আগে আনা এই আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রার্থনাস্থলের (প্লেসেস অব ওয়র্শিপ) ধর্মীয় চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট (ভারতের স্বাধীনতার দিন) যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় রাখতে হবে।’ আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইনটি রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’ অর্থাৎ, বাকি সব মন্দির-মসজিদ বিতর্কে আইনটি প্রয়োগ করা যাবে।

সাংবাদিক জানতে চান, আইনটি নিয়ে যা করার তা আদালত করবে, না সরকার সংশোধনী আনবে। শাহ বলেন, ‘অযোধ্যা নিয়ে আদালতের রায়ের পরে (মন্দির-মসজিদ নিয়ে) যে সমস্ত বিবাদ সামনে আসছে, তার মধ্যে ’৯১ সালের আইনটিও রয়েছে। এটা স্বাভাবিকভাবেই একধরনের চ্যালেঞ্জ…এটা নিশ্চিতভাবেই বলতে চাই, যেকোনো আইনকে আদালতের আইনি পরীক্ষায় পাস হতে হবে। আইনটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, দেখা যাক আদালত কী বলে।’ এর পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন যে কেন্দ্র সরকারের কাছে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন। ‘সরকারের অবস্থান অবশ্যই জানানো হবে,’ বলেন শাহ।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে সরকারের কী অবস্থান হতে পারে, তা এখনই জানা যাবে না। তা জানা যাবে, যখন রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের মতো পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু সরকারের কী অবস্থান হতে পারে, আন্দাজ করা খুব কঠিন কাজ নয়।

তবে সরকার চাইবে এই আইনের পরিবর্তন হোক। ভারতে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে। সেই স্থানের ধর্মীয় চরিত্রের পরিবর্তন করে সেখানে অন্য কিছু বানানো হোক। যার মধ্যে মন্দির হবে অন্যতম, যেমন হয়েছে অযোধ্যায়। কেন্দ্র সরকারের বক্তব্য যে এ রকমই হবে, তা জোরের সঙ্গে বলা যায়। কারণ ’৯১-এর আইনের পরিবর্তন চেয়ে যাঁরা আদালতে গেছেন, তাঁরা সবাই হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈন।

ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্মের আগে যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের জন্ম হয়, তার নাম হিন্দু মহাসভা (১৯১৫)। সেই হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত বিষ্ণুশঙ্কর জৈন ২০২১ সালে এই প্রতিবেদককে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। তিনি স্পষ্ট বলেন, ১৯৯১-এর আইনটি ‘অসাংবিধানিক’ এবং এর পরিবর্তন প্রয়োজন।

তিনি বলেন, এই আইনের পরিবর্তন হলে, ‘হিন্দু পুণ্যার্থীরা তাঁদের প্রার্থনাস্থল (প্লেসেস অব ওয়র্শিপ) ফেরত পেতে পারেন, সংসদ বাধা দিতে পারে না।’ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আদালত বাধা দিতে পারে না এবং বাধা দেওয়া হলে সাধারণ মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে কী করে বসবে, সেই গ্যারান্টি তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় বলেও জৈন জানান। অর্থাৎ, ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে যেভাবে হিন্দুত্ববাদী জনতা অযোধ্যার মসজিদ ধ্বংস করেছিল, সেই একইভাবে আরও অনেক মসজিদ ভাঙা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

আরও পড়ুন

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ভারতে অসংখ্য মসজিদের নিচে অতীতে মন্দির বা হিন্দু দেবতাদের মূর্তি ছিল বা এখনো রয়েছে এমন দাবি করে অসংখ্য হিন্দু সংগঠন ইতিমধ্যে ভারতের নানা আদালতে মামলা করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা নাটোরের সিংড়া উপজেলার এক ঐতিহাসিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ওই ঐতিহাসিককে ব্রিটিশ সরকার বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের খেতাব দিয়েছিল, ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিতও করেছিল। ঐতিহাসিকের নাম যদুনাথ সরকার।

মথুরার শাহি ঈদগাহ মামলায় জৈনরা উদ্ধৃত করেছেন যদুনাথের লেখা থেকে। আগ্রার জামা মসজিদ খুঁড়ে দেখার আবেদনেও উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সরকারের বই থেকে। ১৯৪৭ সালে কলকাতার রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনী। মাসির-ই-আলমগিরি (১৯৫৮-১৭০৭)। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর বছরে (১৭০৭) তাঁর জীবনীকার সাকি মুস্তাদ খান ফারসিতে বইটি লেখেন, যদুনাথ সরকার তা ২০০ বছর পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

বিজেপি গুজরাটে জিতল। শুধু তাই নয়, রেকর্ডসংখ্যক আসন পেয়ে জিতল। জেতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা এটাও পরিষ্কার করে দিল যে আগামী দিনে মেরুকরণ এবং মন্দির-মসজিদের রাজনীতিকেই তারা ব্যবহার করবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য।

বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠায় যদুনাথ লিখছেন, ১৬৭০-এর গ্রীষ্মে আওরঙ্গজেব ‘মথুরায় কেশব রাই-এর মন্দির ভাঙার নির্দেশ দেন।’ পৌরাণিক চরিত্র কৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা বলে মনে করা হয়। জৈনরা ওই বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেছেন, অযোধ্যায় যেমন বাবরের মসজিদ রামের জন্মস্থান, ঠিক তেমনই মথুরায় আওরঙ্গজেবের বানানো শাহি ঈদগাহ কৃষ্ণের জন্মস্থান। ২০২০-এর অক্টোবরে আবেদনটি জেলা আদালতে গৃহীতও হয়।

এ ছাড়া ভারতের দুটি বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য মোগল সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল এবং দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে উপমহাদেশে সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের তৈরি দিল্লির কুতুব মিনারের আইনি অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বেনারসের বিখ্যাত কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরসংলগ্ন জ্ঞানবাপি মসজিদ।

এখানে আরও একটা বিষয় মনে রাখা খুব জরুরি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ঘনিষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী শ্রীধর দামলে তাঁর ১৯৮৭ সালের বই দ্য ব্রাদারহুড ইন স্যাফরন–এ লিখেছেন যেটা ঘোষিতভাবেই আরএসএসের শাখা সংগঠনের নীতি ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় এলে একাধিক মসজিদ সরিয়ে ফেলা হবে। দামলে তাঁর বইয়ে ২৫টির কথা লিখেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তা আরও বেড়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

এ রকম একটা অবস্থায় বিজেপি গুজরাটে জিতল। শুধু তাই নয়, রেকর্ডসংখ্যক আসন পেয়ে জিতল। জেতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা এটাও পরিষ্কার করে দিল যে আগামী দিনে মেরুকরণ এবং মন্দির-মসজিদের রাজনীতিকেই তারা ব্যবহার করবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য। এ অবস্থায় ২০২৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওপরে চোখ থাকবে সবার। তারা কীভাবে এবং কোন বিচারপতিদের দিয়ে এ নতুন মন্দির-মসজিদ বিতর্কের শুনানি করে এবং কী রায় দেয়, তার ওপরে অনেকটাই নির্ভর করবে তার পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনের ইস্যু এবং হয়তোবা ফলাফলও।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা