এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না মিললেও শরিকদের ওপর নির্ভরতা বাড়লেও তৃতীয় দফাতেও নরেন্দ্র মোদি চলবেন তাঁর নিজস্ব ঢঙে। যেভাবে ১০টা বছর দাপিয়ে রাজত্ব করেছেন, কারও কোনো ওজর–আপত্তি কানে তোলেননি, এখনো সেভাবেই চলবেন। আপসের রাস্তায় হাঁটবেন না।
অথচ ভাবা হয়েছিল অন্য রকম। সেই ভাবনা যে অহেতুক ছিল, তা–ও নয়। গড়গড়িয়ে চলা বিজয়রথ ২৭২ থেকে ৩২ ধাপ দূরে থমকে গেলে অমন ভাবনার উদয় হওয়াই স্বাভাবিক।
মনে করা হচ্ছিল, নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুরা শরিক হিসেবে চাপের রাজনীতি শুরু করবেন। অন্যরাও তাঁদের মতো করে পেশি দেখাবেন। সবাই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পাওয়ার গোঁ ধরবেন। অথচ কী দেখা গেল? অমিত শাহকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা যাবে না বলে কেউ গোঁ ধরলেন না। এটা চাই ওটা চাই বলে ধরনা দিলেন না। যেটুকু দেওয়া হলো, সবাই বিনা বাক্যে সেই পাওনা নিয়ে চুপ থাকলেন। নরেন্দ্র মোদি এতটুকুও নুইলেন না। সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বিজেপিরই রইল। বোঝাই গেল না, মোদির ৫৬ ইঞ্চি ছাতি চুপসে ৪৬ হয়েছে।
মোদি চরিত্রে ছোটখাটো দু–একটা পরিবর্তন যে আসেনি, তা অবশ্য নয়। এই যেমন ১০ বছর ধরে যিনি ‘মোদি সরকার’ বা ‘আমার সরকার’ বলে এসেছেন, তিনি এখন ‘এনডিএর সরকার’ বলছেন। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত একবারের জন্য ভুলেও তিনি ‘মোদি কি গ্যারান্টির’ উল্লেখ করেননি। আমিত্বের বড়াই করেননি। এর একটা কারণ যদি হয় সরকার গঠনে শরিকনির্ভরতা, অন্য কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবতের প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ।
আত্মম্ভরিতা ও অহংবোধের যে সমালোচনা মোহন ভাগবত করেছেন, মোদি বুঝেছেন, আপাতত তাতে রাশ টানা না গেলে বিপদ বাড়তে পারে। কিন্তু তা করতে গিয়ে এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি, যাতে বোঝা যায় তাঁর উঁচু মাথা হেঁট হয়েছে। কর্তৃত্ব কিছুটা খর্ব হয়েছে। এত বছর ক্ষমতার শীর্ষে থেকে তিনি বুঝেছেন, সেই আভাস দেওয়ার অর্থ শরিকদের বায়না ও চাপের কাছে নিত্য সমর্পণ করা। তেমন করলে নিজের কাছেই তিনি খর্বকায় হয়ে যাবেন। আত্মমগ্ন যাঁরা হন, নার্সিসিস্ট, তাঁদের চরিত্র এমনই হয়।
মোদি আরও একটা পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এত দিন নিজের ক্ষমতা জাহির করে দেশ চালানোর পর এই প্রথম ‘সহমত’ বা ‘ঐকমত্য’ শব্দ আওড়াতে শুরু করেছেন। এটা তাঁর দ্বিমুখী কৌশল।
সহমতের কথা বলে একদিকে তিনি যেমন সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে শরিকদের গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন, অন্যদিকে চাইছেন বিরোধী সমালোচনার তির ভোঁতা করতে। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের আগে তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণ কাটাছেঁড়া করলে তিনটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাবে।
প্রথমত, তিনি বলেছেন, সরকার চালাতে সংখ্যা লাগলেও দেশ চালাতে সহমতের প্রয়োজন। এই মন্তব্যের একটা লক্ষ্য শরিকদের গুরুত্বদান, অন্য লক্ষ্য নিজেকে গণতন্ত্রী প্রতিপন্ন করা।
অনেক কিছুর বদল ঘটতে পারে বছর শেষে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা হারায় এবং বিরোধী জোট যদি ঝাড়খন্ড দখলে রাখে, তা হলে রাজনীতিতে অন্য খেলা শুরু হতে পারে। নরেন্দ্র মোদির কাছে সেটা হবে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তত দিন পর্যন্ত মোদি থাকবেন মোদিতেই।
দ্বিতীয়ত, তিনি সংবিধান রক্ষা করার কথা বলেছেন। এটা না বলে উপায় ছিল না। কারণ, ভোটের প্রচারে বিরোধীরা তাঁকে সংবিধানের সম্ভাব্য খুনি হিসেবে চিত্রিত করেছিল। বহু মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল, বিজেপি চার শর বেশি আসন পেলে আম্বেদকরের তৈরি সংবিধান বদলে দেবে। সেই প্রচার দলিত ভোটের একটা বিরাট অংশ কংগ্রেসসহ বিরোধী জোটকে পাইয়ে দিয়েছে। উত্তর প্রদেশে বে–আব্রু করে দিয়েছে বিজেপিকে।
তৃতীয়ত, মোদি মেলে ধরেছেন কংগ্রেসের জারি করা জরুরি অবস্থাকে। আগামী বছর জরুরি অবস্থা জারির ৫০ বছর পূর্তি। ইন্দিরা গান্ধীর সেই সিদ্ধান্তকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মোদি চেয়েছেন এটাই প্রমাণ করতে, যারা সংবিধানের সর্বনাশ করেছিল, তারা কিছুতেই সংবিধানের রক্ষক হতে পারে না। মোদির সেই ভাষণের রেশ স্পিকার ওম বিড়লা এবং সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভাষণেও প্রকট। কংগ্রেসই ওই আক্রমণের মূল লক্ষ্য।
এই কৌশলগত ছোটখাটো রাজনৈতিক বদলগুলো বাদ দিলে নরেন্দ্র মোদি কিন্তু অপরিবর্তিতই। ১০টি বছর যে ঢঙে দাপটের সঙ্গে সরকার চালিয়ে এসেছেন, তা থেকে কণামাত্র বিচ্যুত হননি। বরং যাঁরা মনে করছিলেন, এবার হয়তো তিনি কিছুটা সংযত হবেন, বিনম্র হবেন, শরিকদের মন জুগিয়ে চলতে বাধ্য হবেন, তাঁদের বাবা বাছা করবেন, সংখ্যায় ফুলে ফেঁপে ওঠা বিরোধীদের সমীহ করবেন, তাঁরা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। কয়েকটি নিদর্শন সবার চোখের সামনে রয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে তাঁর কাজের ধরনে বিন্দুমাত্র লাগাম পড়েনি।
প্রথম নমুনা লোকসভার প্রোটেম বা অস্থায়ী স্পিকার বাছা। প্রোটেম স্পিকারের কাজ খুবই সীমিত। ভোটে জিতে যাঁরা নতুন সংসদের সদস্য হয়েছেন, তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করানো। সাধারণত এই কাজে বেছে নেওয়া হয় লোকসভায় সবচেয়ে বেশিবার যিনি জয়ী তাঁকে। সেই নিরিখে কেরালা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসের সদস্য কে সুরেশই সর্বজ্যেষ্ঠ। তিনি আটবারের সংসদ সদস্য।
কিন্তু তাঁকে না বেছে মোদি বাছলেন ওডিশা থেকে সাতবারের জয়ী ভর্তৃহরি মহতাবকে। এই ভদ্রলোক ভোটের আগে বিজেডি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে মনোনীত করার কারণ হিসেবে বলা হলো, সুরেশ পরপর আটবার জেতেননি। মাঝখানে দুবার হেরেছিলেন। মহতাব একবারও না হেরে সাতবারের সংসদ সদস্য! কংগ্রেসকে কোনোভাবেই প্রাধান্য না দেওয়ার এই গোঁ মোদির নিজস্ব। ২৪০–এ থমকে গেলেও নমনীয় হওয়ার কোনো লক্ষণ তিনি দেখাতে নারাজ।
দ্বিতীয় নমুনা, স্পিকার পদে পুরোনো মুখ ওম বিড়লাকে বেছে নেওয়া এবং প্রথামাফিক ডেপুটি স্পিকার পদ বিরোধীদের ছাড়া হবে সেই আশ্বাস না দেওয়া। ওম বিড়লাকে বাছার মধ্য দিয়ে মোদি বোঝালেন সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতায় ছেদ দেবেন না। ডেপুটি স্পিকার পদটা বিরোধীদের ছেড়ে দিলে সহমতের বার্তা তিনি ছড়িয়ে দিতে পারতেন। তিনি যে গণতন্ত্রী, তা বোঝাতে পারতেন। স্পিকারও সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে, বিরোধীদের সেই শর্ত মানলে তাঁর দুর্বলতা প্রকট হতো। সেটা হতো তাঁর চরিত্রের স্খলন। ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধীদের দিলে সেটা হবে তাঁর চরিত্রবিরোধী।
মোদির চরিত্র যে বিন্দুমাত্র বদলায়নি, তার তৃতীয় প্রমাণ ১৪ বছরের পুরোনো বিস্মৃতপ্রায় এক ভাষণের অভিযোগে অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে কালা কানুন বলে চিহ্নিত ‘ইউএপিএ’ আইনে মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত।
চতুর্থ প্রমাণ, জামিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আদালত থেকে সিবিআইয়ের গ্রেপ্তারি। আবগারি (মদ) মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ২১ মার্চ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করলেও ঘুষের ১০০ কোটি টাকা কোথায়, আজও তা প্রমাণ করতে পারেনি। সিবিআই তদন্ত করছে জনপ্রতিনিধি হয়ে কেজরিওয়ালের দুর্নীতি ও ঘুষ খাওয়ার অভিযোগের।
এত দিন পর কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করার ছকটা হলো ইডির মামলায় জামিন পেলেও সিবিআই তদন্তের নামে তাঁকে আরও মাস কয়েক বন্দী রাখা। এরপর প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেলে অন্য কথা। এই দুই ঘটনা কিসের ইঙ্গিত? ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগের বিরোধী দমন অভিযানেও এখনই কোনো বদল ঘটছে না।
তবে অনেক কিছুর বদল ঘটতে পারে বছর শেষে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা হারায় এবং বিরোধী জোট যদি ঝাড়খন্ড দখলে রাখে, তা হলে রাজনীতিতে অন্য খেলা শুরু হতে পারে। নরেন্দ্র মোদির কাছে সেটা হবে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তত দিন পর্যন্ত মোদি থাকবেন মোদিতেই।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি