মঙ্গলবার ভারতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, তেমনই এ ক্ষেত্রেও গেল গেল রব উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি কি শরিকদের নিয়ে চলতে পারবে বা নরেন্দ্র মোদি কি সরতে বাধ্য হবেন, দলের ভেতরে এবং বাইরের চাপে?
আমার বিবেচনায় এসবের স্পষ্ট উত্তর হলো না, কোনোটাই হবে না। বরং বিজেপি ফের শক্তি সঞ্চয় করে ভবিষ্যতে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে এবং অচিরেই হয়তো দেখা যাবে যে তারা রাজ্যস্তরে বিধানসভা নির্বাচন জিততে শুরু করেছে। এর পাঁচটি কারণ ব্যাখ্যা করছি।
প্রথমত, গতকাল বিজেপি একটা ধাক্কা খেয়েছে। ভারতের বড় অংশের মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁদের মতামত পরিষ্কার করেছেন। অনেকে এ মতামতকে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে মতামত বলে মনে করছেন। আমি মনে করি এটা ভ্রান্ত ধারণা। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরে হিন্দুত্ববাদ ভারতের গভীরে প্রোথিত হয়েছে, যা শিকড় থেকে ওপড়াতে বহু দশক লাগবে। এর প্রধান উদাহরণ হলো, শুধু বিজেপি নয়, সব দলই রাজ্য এবং জাতীয় নির্বাচনে উত্তরোত্তর কমসংখ্যক মুসলমান প্রার্থীদের মনোনয়ন দিচ্ছে। মন্দিরের রাজনীতি সব দল, এমনকি মুসলমানপ্রধান দলগুলোও মেনে নিয়েছে।
গত ১০ বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে সমাজ এবং সংস্কৃতির চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে। এই নির্বাচনের ফলে সেই চরিত্রের ফের পরিবর্তন হলো, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কিছু মানুষ বাড়তি করের কারণে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বা বিজেপির খানিকটা ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে (যেমন সেনাবাহিনীতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ বা কৃষিনীতি) একটা ধাক্কা খেয়েছে। এটা হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি নয়।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই হিন্দুত্ববাদের মধ্য দিয়েই নরেন্দ্র মোদির উত্থান, তাই এটাও ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই যে তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। হতে পারে যে সাংঘাতিক মোদি-হাওয়া গত দুটি নির্বাচনে ছিল, তার গতি কমেছে।
কিন্তু আজকের দিনেও নরেন্দ্র মোদি জনপ্রিয়তার নিরিখে ভারতের সব নেতা-নেত্রীর থেকে লক্ষ যোজন এগিয়ে। আমেরিকার সমীক্ষা সংস্থা ‘মর্নিং কনসাল্ট’ দৈনিক ভিত্তিতে বিশ্বের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের জনপ্রিয়তা মাপে। বুধবারও সেই জরিপ সংস্থা মোদিকে বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে রেখেছে।
তৃতীয়ত, মোদি সম্পর্কে আজকে দাঁড়িয়ে মনে করা হচ্ছে যে তিনি অতীতে শরিকদের নিয়ে চলেননি বলে ভবিষ্যতেও পারবেন না। এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে মনে করি।। তিনি অতীতে বারবার প্রমাণ করেছেন যে তিনি পরিস্থিতির বিচারে নিজেকে পরিবর্তন করতে, নমনীয় করতে সক্ষম। বর্তমানের মোদি অতীতের মোদির থেকে আলাদা এ কথা যেমন ঠিক, তেমন এ কথাও ঠিক যে অতীতই বর্তমান নির্ধারণ করে।
গুজরাট-দাঙ্গার পরবর্তী পর্যায়ে ২০০২ সালে মোদি অত্যন্ত ছোট এক নেতা ছিলেন। ভারত সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ছিল তাঁকে সরানোর জন্য। এমনকি তাঁর দলের প্রধান সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর ওপরও চাপ ছিল।
পরিস্থিতি সামনে থেকে মোকাবিলা করে সেই ঝড় সামলে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি, নানাভাবে। তিনি জানেন, রাজনীতিতে অনেক সময় মাথা নোয়াতে হয়, নমনীয় হতে হয়। এত দিন নমনীয় হওয়ার প্রয়োজন হয়নি বলে তিনি হননি। এবার যখন হবে, তখন তিনি মাথা নোয়াবেন, নমনীয় হবেন।
এভাবে তিনি কিছুদিন সরকার চালাবেন। তারপর বিজেপি নতুন উদ্যমে মাঠে নামবে, দু-একটা রাজ্য বিধানসভায় জয়ের পর। তারা ফের অন্য দলকে ভেঙে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে, অন্য দলের এমপিদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টা করবে। যা তারা অতীতে করেছে। ফলে আজকে বিজেপির কাছে ২৪০ আসন থাকলেও দুই বছর পর এই সংখ্যা বেড়ে কত হয়, সেটাই দেখার।
চতুর্থত, বিজেপি এমন একটা দল, যেটা যেকোনো হারের মূল্যায়ন অন্য দলের থেকে অনেক ভালো করে। যেটা একসময় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি করতে পারত। অন্য দলের ভেতরে কী ধরনের কন্ট্রাডিকশন বা বিরোধ আছে, তা খতিয়ে দেখে এবং নিজেদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে বিজেপি নতুন উদ্যমে মাঠে নামে। একে তারা বলে আত্মচিন্তন, নিজেদের বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণের পর তারা একটা সিদ্ধান্ত নেয় এবং মাঠপর্যায়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সেই সিদ্ধান্তকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যা চট করে অন্য দল পারে না।
কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদি ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কবে ঘুরে দাঁড়াবে বা আদৌ দাঁড়াবে কি না, বলা মুশকিল। এর প্রধান কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেমন সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ইত্যাদি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করা সম্ভব। মানুষ এবং বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভয় দেখিয়ে জেতা সম্ভব।
লেনিনবাদী যে কমিউনিস্ট রাজনীতি, সেই রাজনীতিও এটাই করে। তারা বলে, পার্টি শেষ কথা। পার্টির ভেতরে মতবিরোধ থাকবে, আলাপ-আলোচনা হবে। কিন্তু আলাপ-আলোচনা শেষে সর্বসম্মতভাবে পার্টি যখন একটা সিদ্ধান্ত নেবে, তখন সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো। কমিউনিস্ট নেতারা যেমন বারবার বিপদে পড়ে পার্টির কাছে ফিরেছেন, তেমনি মোদিও ফিরে যাবেন পার্টির কাছে। পুরোনো নেতাদের কাছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলবেন। মাথা নত করবেন এবং আগামী দিনে ফিরে আসবেন।
পঞ্চম ও শেষ যুক্তি হলো, আজ মনে করা হচ্ছে শরিক দল নিয়ে রাজনীতি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, বিপদ রয়েছে এবং এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের শক্তি ক্ষয় হতে বাধ্য। আমার যুক্তি এর উল্টো। এর ফলে বরং ক্ষমতাসীন দলের শক্তি বৃদ্ধি হয়।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) ২০০৪ এবং ২০০৯ সালের সরকারকে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০০৪ সালের ইউপিএ সরকারের ওপর শরিকদের চাপ, বিশেষত বামপন্থীদের চাপ অনেক বেশি ছিল। সে কারণে তারা এমন অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল যা ছিল ‘প্র-পিপল’ বা মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার কর্মসূচি। এর ফলে এর পরের নির্বাচন, অর্থাৎ ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ১৪৫ (২০০৪) থেকে বেড়ে ২০৬ (২০০৯) হয়ে যায়।
পরে তারা অবজ্ঞা করতে শুরু করে শরিকদের, ধীরে ধীরে দূরে সরে যায় মানুষের থেকে এবং শোচনীয়ভাবে হারে ২০১৪ সালের নির্বাচনে। অর্থাৎ যত বেশি শরিক, তত আরও বেশি করে প্রধান ক্ষমতাসীন দল মানুষের কাছাকাছি থাকে।
যত সে এককভাবে সরকার চালায় এবং এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তত সে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, মানুষের থেকে দূরে সরে যায়। যেটা পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের হয়েছিল। কংগ্রেসের অতীতে হয়েছে। বিজেপির হয়েছে গত ১০ বছরে। ফলে নতুন শরিকেরা বিজেপিকে আরও মানুষের কাছাকাছি রাখবে। এর ফলে বিজেপি শুধু শিল্পপতিদের জন্য নয়, মানুষের জন্যও অনেক কাজ করতে বাধ্য হবে। এতে মোদির জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে, ফলে বিজেপিও জিতবে, হয়তো এককভাবেই।
কেন বারবার ব্যর্থ হয় বাংলায় বিজেপি
তবে কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদি ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কবে ঘুরে দাঁড়াবে বা আদৌ দাঁড়াবে কি না, বলা মুশকিল। এর প্রধান কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেমন সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ইত্যাদি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করা সম্ভব। মানুষ এবং বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভয় দেখিয়ে জেতা সম্ভব।
সব রাজনৈতিক দলেরই নানান খামতি থাকে, দুর্বলতা থাকে। রাজনৈতিকভাবেই তার মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি তা করতে নারাজ। তারা যোগ্য প্রার্থী অধিকাংশ আসনে দিতে পারেনি, পশ্চিমবঙ্গে বড় অংশের বুথে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি, দলের ভেতরে পুরোনো বনাম নতুন বিজেপির লড়াই চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে—এসব বড় সমস্যা। এ সমস্যা প্রমাণ করে নানা স্তরে তাদের সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ না করে রাজ্য নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ইডি, সিবিআই, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, কেন্দ্র সরকার এসব দেখায় এবং বারবার ব্যর্থ হয়।
এ কাজটা ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান করেছিল সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে। তারা কেন্দ্রীয় এবং সামরিক শাসন দেখিয়েছিল মানুষকে। তা করে সেদিনের বাঙালিকে, বাংলাদেশের বাঙালিকে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ১৯৭১-এ। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকেও পারল না ২০২৪ সালের ৪ জুন।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা