আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নির্বাচন নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছিল। কবে নাগাদ নির্বাচন হবে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে একটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল সরকারকে।
নির্বাচন নিয়ে এত দিন ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও সরকারের বিভিন্ন মহল গত কয়েক দিনে মোটামুটি নিশ্চিত করেছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে হয়তো বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার হয়তো আর ১২ থেকে ১৮ মাস রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। এরপরই আমরা ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার হয়তো দেখতে পাব।
বর্তমানে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগই মনে করছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি হয়তো ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে।
এত বড় একটা বিপ্লবের পর দেশের নাগরিকেরা কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের কাছে গতানুগতিক রাজনৈতিক আচরণ প্রত্যাশা করছে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে অনেক সতর্ক হতে হবে, তারা দল হিসেবে নিজেদের কোন পথে পরিচালিত করবে, সেটা তাদের নির্ধারণ করতে হবে।
বিএনপি এই মুহূর্তে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। ৩১ দফা নিয়ে জেলায় জেলায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনলাইনে এসব সভায় উপস্থিত হয়ে সরাসরি বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি পরিবর্তনের পক্ষে।
তারেক রহমান নিয়মিত তাঁর নেতা-কর্মীদের বলছেন, যদি ভোটে বিএনপি জয়ী হয়, তাহলে তাঁরা ক্ষমতায় যাবেন না; বরং দায়িত্ব পাবেন। সেই দায়িত্ব যাতে সঠিকভাবে পালন করা যায়, এ জন্য তিনি তাঁর নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছেন। এই যেমন তাঁদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা যেন মার্জিত হন; তাঁরা যেন কোনো অপকর্মে লিপ্ত না হন ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে কি এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে?
মানুষ যখন দেখছে বিএনপির কোনো নেতা এখন এই তরুণদের নিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘ওরা কারা’ বলে বিদ্রূপ করছে, মানুষের মনে তখন কিন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, যাঁরা বিএনপিকে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন, বিএনপি যদি তাঁদের সঙ্গেই এমন আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা কী করবে!
বাস্তবতা হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি চলছে অনেকটা প্রকাশ্যে। কে বা কারা চাঁদাবাজি করছে, এ নিয়ে হয়তো তর্ক হতে পারে।
সপ্তাহখানেক হয় আমি দেশে এসেছি। সাধারণ মানুষ হিসেবে দেশে এসে আমি নিজে শহরের বিভিন্ন গলি কিংবা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছি। সেখান থেকে যে তথ্যগুলো পাচ্ছি, সেগুলো কিন্তু জানান দিচ্ছে ভিন্ন চিত্র।
বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী কিংবা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে চাঁদাবাজি করছে। তারেক রহমানের উচিত হবে এখনই এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া।
বিএনপি একটা বড় দল। তারেক রহমান চাইলেই কিন্তু একটা ডেটাবেজ তৈরি করতে পারেন। যেখানে যারাই চাঁদাবাজি কিংবা কোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের নাম-ঠিকানাসহ সব তথ্য চলে আসবে। দেশের সাধারণ কোনো নাগরিক যদি কোনোভাবে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীর দ্বারা হয়রানির শিকার হন, তখন তাঁরা যেন নির্ভয়ে নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে এসব তথ্য ডেটাবেজে দিতে পারেন।
আর এই পুরো কাজ করার জন্য তরুণ কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীকেও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যাঁদের হয়তো মাঠের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দরকার নেই।
বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের মধ্যে অনেক দিন ধরেই একটা টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছিল। সেটি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সেদিন এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিএনপির এক নেতা নাগরিক কমিটির এক নেতাকে বলছেন, ‘আপনারা কে?’
এ নিয়ে তরুণসমাজে কিন্তু বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনে যাঁরা বিএনপির হয়ে লেখালেখি করেন, যাঁদের সমাজে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রয়েছে, তাঁদের অনেককে এই তরুণদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
তারেক রহমানের উচিত হবে খুব দ্রুত এই জায়গাকে আমলে নেওয়া। এমন কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীকে নিয়োগ দেওয়া দরকার, যাঁরা ছাত্রসমাজের সঙ্গে বিএনপির যে অনৈক্য কিংবা টানাপোড়েন চলছে, তার অবসান ঘটাতে পারবেন।
ভুলে গেলে চলবে না, এই তরুণেরাই কিন্তু হাসিনার পতন ঘটিয়েছেন। এই তরুণদের জন্যই আজকে একটা স্বাভাবিক নির্বাচন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই তরুণদের জন্যই বিএনপি এখন সারা দেশে নিজেদের সংগঠিত করতে পারছে। এই তরুণেরাই বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পরিবেশ তৈরি করেছেন।
মানুষ যখন দেখছে বিএনপি এখন এই তরুণদের নিয়ে প্রশ্ন করছে, ‘ওরা কারা’ বলে বিদ্রূপ করছে, মানুষের মনে তখন কিন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, যাঁরা বিএনপিকে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন, বিএনপি যদি তাঁদের সঙ্গেই এমন আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা কী করবে!
তাই তারেক রহমানের উচিত হবে এই বিষয়গুলোর মীমাংসা করার জন্য এমন কিছু মানুষকে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া, যাঁরা তরুণ প্রজন্মের ভাষা বোঝেন, যাঁরা তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন এবং যাঁরা পুরোনো বিভেদের রাজনীতি ভুলে ঐক্যের রাজনীতির দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবেন। আর কাজটা করতে হবে খুব দ্রুতই।
আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
(মতামত লেখকের নিজস্ব)