২০১৬ সালের ৩১ মার্চ কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে একটি নির্মাণাধীন উড়ালসড়ক ধসে ২৭ জন নিহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হতবাক হন। মর্মাহত হন। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘সেতুটি পড়ে গেছে। এটি ভগবানের কাজ নয়, এটি প্রতারণার কাজ। তবে আপনি কোন ধরনের সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছেন, তা নির্বাচনের আগে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে জনগণকে জানিয়ে দেওয়ার কাজটা অবশ্যই ভগবানই করেছেন। ভগবান মানুষকে এই বার্তা দিয়েছেন যে আজ যার কারণে এই উড়ালসড়কটি পড়ে গেছে, কাল তিনি পুরো রাজ্যকে শেষ করে দেবেন।’
গুজরাটের মরবিতে মাচ্চু নদীর ওপরে থাকা ১৪৩ বছরের পুরোনো ঝুলন্ত সেতুটি ‘মেরামত ও সংস্কার’-এর জন্য সাত মাস বন্ধ রাখার পর গত ২৬ অক্টোবর জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনিতেই এই সেতু সব সময়ই পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিল।
যে দিনটিতে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়, সেদিন ঘটনাচক্রে ছিল দেওয়ালির ও গুজরাটি নববর্ষের দিন। স্বাভাবিকভাবেই সেদিন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী ও পর্যটক সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিন সবাই এই ঝুলন্ত সেতু দেখার ও সেটি পার হওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারলেও ৩০ অক্টোবর রোববার সেতুটি ধসে পড়ে। এ ঘটনায় মারা গেছে অন্তত ১৩৫ জন। তাদের মধ্যে ৫৩ জনই শিশু।
এখন আসল ঘটনা যতই সামনে আসছে, তত একের পর এক প্রশ্ন উঠছে এবং সে প্রশ্নগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক।
এখানে প্রশ্নগুলোর একটি নমুনা ও উত্তর রয়েছে:
১. সেতুটি মেরামত ও সংস্কারের কাজ করার জন্য ঠিকাদার বেছে নিতে কোনো টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল? উত্তর: সম্ভবত, না।
২. ঠিকাদার নিয়োগের দায়িত্ব কার ছিল? উত্তর: খুব সম্ভবত, রাজ্য সরকারের নগর উন্নয়ন দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে মরবি পৌরসভা।
৩. সেতুটা মেরামত করার জন্য সেতুটির কাঠামোগত অবস্থা কেমন ছিল, তা নিয়ে কোনো প্রকৌশল প্রতিবেদন ছিল কি না। উত্তর: সম্ভবত, না। এখন পর্যন্ত রাজ্য সরকার বা মরবি পৌরসভা বা পুলিশ এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন ছিল বলে দাবি করেনি।
৪. যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সংস্কারের কাজটি করেছে, তারা কি এই ধরনের একটি বড় কাজ চালানোর জন্য যোগ্য ছিল? উত্তর: সম্ভবত, না। ঠিকাদার ছিল ওরেভা নামে একটি কোম্পানি। এটি একটি ঘড়ি প্রস্তুতকারী (মরবি শহরে এটির ঘড়ির জন্য বিখ্যাত) প্রতিষ্ঠান এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেতু মেরামতের জন্য প্রযুক্তিগত যোগ্যতা বা পূর্ব অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না।
৫. জনসাধারণের জন্য সেতুটি পুনরায় উন্মুক্ত করার জন্য ঠিকাদার কি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছিল? উত্তর: না। মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ সেতুটি পুনরায় খোলার বা অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে কিছু জানত না বলে জানিয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় ‘দায়বদ্ধতা’ শব্দটি অনুপস্থিত। ট্র্যাজেডির পরে, কেউ ক্ষমা চায়নি, কেউ পদত্যাগের প্রস্তাব দেয়নি। নিন্দুকেরা বলবে, এ ঘটনায় কাউকে জবাবদিহি করা হবে না এবং শাস্তি দেওয়া হবে না। ভগবান যদি শুনে থাকেন, তাহলে কি তিনি মোদির কথা ধার করে গুজরাটের জনগণকে বার্তা পাঠাবেন?
কলকাতার উড়ালসেতু ধস এবং মরবি ব্রিজ ভেঙে পড়ার মধ্যে কিছু মিল আছে। কলকাতা ট্র্যাজেডিতে অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাঁদের সবাইকে শিগগিরই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তঁাদের মধ্যে ঠিকাদার এবং সাবকন্ট্রাক্টরের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরা ছিলেন। এত কিছুর পরও গত ছয় বছরে এর বিচার শুরু হয়নি। কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন থাকলেও মোটামুটি এর সব লক্ষণই মরবি ট্র্যাজেডিতে প্রযোজ্য হতে পারে।
মরবির ঘটনার পর ছোটখাটো কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে (ঠিকদার বা সাব-কন্ট্রাক্টর বা কোম্পানির মালিকদের কাউকে নয়)। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে যথারীতি সহানুভূতির স্বাভাবিক বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণের স্বাভাবিক ঘোষণা এসেছে। একটি স্বাধীন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের স্বাভাবিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এবং পদত্যাগের বিষয়ে যথারীতি নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় ‘দায়বদ্ধতা’ শব্দটি অনুপস্থিত। ট্র্যাজেডির পরে, কেউ ক্ষমা চায়নি, কেউ পদত্যাগের প্রস্তাব দেয়নি। নিন্দুকেরা বলবে, এ ঘটনায় কাউকে জবাবদিহি করা হবে না এবং শাস্তি দেওয়া হবে না। ভগবান যদি শুনে থাকেন, তাহলে কি তিনি মোদির কথা ধার করে গুজরাটের জনগণকে বার্তা পাঠাবেন?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
পি চিদাম্বরম ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেস পার্টির নেতা