বিজেপি-মমতা সম্পর্কে কি নতুন বাঁক

নরেন্দ্র মোদি

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে আর দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন। তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতির অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ হলো কোন দল কাকে সমর্থন দিচ্ছে, সেটা বোঝা।

এই সময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার রাতে মন্তব্য করেছেন, বিরোধী জোটের প্রার্থী কংগ্রেসের মার্গারেট আল্ভাকে তৃণমূল সমর্থন দিচ্ছে না। বিজেপি–সমর্থিত প্রার্থী জগদীপ ধনখড়কেও সমর্থন দেবে না তাঁর দল।

বৃহস্পতিবারই শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে মমতা কড়া ভাষায় বিজেপিকে আক্রমণ করলেও, এ–ও পরিষ্কার করে দেন যে বিজেপিবিরোধী ১৭-দলীয় জোটের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক আর নেই। তাঁর কথায়, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তখন সবাই এমনিতেই এক হয়ে যাবে। অর্থাৎ, আপাতত কোনো বিজেপিবিরোধী জোট ভারতে করার প্রয়োজন নেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বস্তুত, কলকাতায় মমতার এই মন্তব্যের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জোটের অপর নেতা জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আবদুল্লাহ শ্রীনগর থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেন, ‘বিরোধী জোট এক অবাস্তব স্বপ্ন। রাজনৈতিক দল সেই কাজই করবে, যা তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে। বিষয়টা জম্মু-কাশ্মীরে ২০১৯ সাল থেকে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, যখন আমাদের তথাকথিত বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অযথা সময় নষ্ট না করে ন্যাশনাল কনফারেন্সেরও সেটাই করা প্রয়োজন, যা তাদের করা উচিত।’

ফলে বোঝা যাচ্ছে, আগামী দিনে, অন্যান্য দল সরাসরি ঘোষণা দিয়ে এই জোট ছাড়বে, আবার কেউ কেউ টিকে থাকবে। আর সার্বিক জোট হলেও, নির্বাচনে সেই জোট জেতার অবস্থায় না পৌঁছালে মমতা যে তাতে সক্রিয়ভাবে থাকবেন না, তা গত কয়েক দিনে স্পষ্ট।

রাজ্যসভায় তৃণমূলের সাবেক সদস্য যশোবন্ত সিনহাকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু জুলাই মাসের গোড়ায় মমতা বলেন, বিজেপি তাঁকে তাদের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কে আগে জানালে, তিনি এই আদিবাসী প্রার্থীকেই সমর্থন করতেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে নিজের জোটের প্রার্থীকে কার্যত হারিয়ে দিলেন মমতা। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যশোবন্ত সিনহা জিতবেন না। হতে পারে, তিনি বিজেপিকে খুশি করার চেষ্টা করলেন।

২.

১৩ জুলাই মমতা দার্জিলিংয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বাসভবনে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে ছিলেন পূর্ব ভারতে মমতার প্রবল সমালোচক আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও। ‘হিমন্তর সঙ্গে দেখা করে ভালো লাগল। আমাদের যে সম্পর্ক তা বজায় রাখা উচিত। কারণ, আসামের প্রচুর মানুষ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন এবং বাঙালি আসামে রয়েছেন।’—মমতার এমন মন্তব্যে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে যে তিনি এবং বিজেপি কাছাকাছি আসছে।

এই বৈঠকের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিজেপি জানাল উপরাষ্ট্রপতি পদে তাদের পছন্দের লোক জগদীপ ধনখড়, যিনি বছর বিশেক আগেও রাজস্থানে কংগ্রেসের এমএলএ ছিলেন। ধনখড়ের আহ্বানে পূর্ব ভারতে বিজেপির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিমন্ত দার্জিলিংয়ে এসে মমতার সঙ্গে বৈঠক করলেন।

দার্জিলিংয়ের বৈঠককে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ বলা হলেও সেই বৈঠক দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলায় আরও বেশি জল্পনা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া, বৈঠক হয়েছে বিজেপির উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী ঘোষণার তিন দিন আগে। বিষয়টা এতই তাৎপর্যপূর্ণ এবং রহস্যাবৃত যে বিজেপির নীতির সমর্থনকারী দক্ষিণপন্থী ওয়েব পোর্টাল ‘স্বরাজ্য’ লিখছে, ‘সাংবিধানিক পদে থেকে ধনখড় কীভাবে একটি রাজনৈতিক বৈঠক আহ্বান করতে পারেন?’

‘স্বরাজ্য’ আরও মনে করিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিশ্বশর্মা এবং মমতাকে তিনি ‘একনায়ক’ এবং ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। বিশ্বশর্মা বাঙালি মুসলিমবিরোধী রাজনীতি করেন, মমতা সরকার টিকে রয়েছে বাঙালি মুসলমানের ওপরে।

‘স্বরাজ্য’ বলছে, দার্জিলিংয়ের বৈঠক পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নেতা-কর্মীদের যেটুকু মনোবল অবশিষ্ট আছে, তা শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবেই সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) সঙ্গে রাজ্য স্তরে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসকে শেষ করে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা ‘স্বরাজ্য’-কে বলেছেন, হিমন্ত-মমতা বৈঠক বিজেপির ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, বিশেষত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয়।’ সেটি যদি সত্যি হয় তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এক নতুন বাঁকে পৌঁছেছে।

‘স্বরাজ্য’ আরও বলছে, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নানান আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তৃণমূলের নেতা অভিষেককে নিয়মিত জেরা করছে। এর ফলে তিনি বিপর্যস্ত। অভিষেকের ওপরে তৈরি হওয়া চাপ কমাতেই বিজেপিকে সন্তুষ্ট করার কৌশল নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বিজেপির কখনোই এ চাপ কমানো উচিত নয় বলে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য।

তবে বৃহস্পতিবারে মমতা ও অভিষেকের বিবৃতি প্রমাণ করছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতেই বিরোধী রাজনীতি ফের পাল্টাচ্ছে এবং বিজেপিবিরোধী জোটের যে হাওয়া মাস কয়েক আগে উঠেছিল, তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে। এতে বিরোধীদের কতটা লাভ হবে জানা না থাকলেও, বিজেপির যে হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।

৩.

বিজেপির কাছাকাছি যাওয়ার কী অর্থ তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে ভালো যিনি বোঝেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির সামান্য কাছাকাছি আসার জেরে, তখত খোয়াতে হয়েছিল সিপিআইএমের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকার (১৯৯৯-২০০৪) ক্ষমতায় থাকাকালীন, ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় আমেরিকার কনসাল জেনারেলের অফিসে সন্ত্রাসী হামলা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাটে দাঙ্গা হয়।

এই রকম একটা স্পর্শকাতর সময়ে, বিজেপির তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে বৈঠক সেরে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রায় এই একই সময়ে তিনি এ–ও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় সন্ত্রাসবাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের ধীরে ধীরে সিপিআইএমের ওপরে আস্থা কমতে শুরু করে।

কেন্দ্রে সে সময় বিজেপি সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৯)। তিনি ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যে লড়েন। আর ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধেন। দুটি নির্বাচনেই তিনি বামফ্রন্টের কাছে পুরোপুরি পরাস্ত হন।

মমতা বুঝতে পারেন, বিজেপির কাছাকাছি থেকে পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান, সেখানে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। ২০০৪-এর পরে, তিনি দ্রুত বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ান। অতএব বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানো কতটা ঝুঁকির, সেটা মমতা থেকে ভালো কেউ বোঝেন বলে মনে হয় না।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রায় নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে বলা যায় ভারতে ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় থাকবে বিজেপি। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে রাজ্যে ক্ষমতাসীন স্থানীয় দলের পক্ষে দীর্ঘকাল লড়াই করে টিকে থাকা মুশকিল। সেটাও মমতা বোঝেন। ফলে তিনি এটাও জানেন যে তাঁকে বিজেপির সঙ্গে একটা আদান–প্রদানের রাজনীতির মধ্যে থাকতে হবে।

সেই আদান-প্রদানের সূক্ষ্ম ‘ব্যালান্সিংয়ের’ যে খেলা, তাতে সম্ভবত সর্বশেষ সংযোজন উপরাষ্ট্রপতি পদে ভোটদান থেকে বিরত থাকা। এর থেকে প্রমাণিত হয় না যে মমতা বিজেপির সঙ্গে চূড়ান্তভাবে হাত মিলিয়েছেন। আবার এ–ও প্রমাণিত হয় না যে তিনি বিজেপির থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছেন।

কিন্তু মোটামুটি জোর দিয়ে একটা কথা বলা যায়, বৃহস্পতিবারের পরে বিরোধী জোটের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।

এখন দেখার বিষয়, বিজেপিও পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ্যপাল হিসেবে কাকে রাজ্যে পাঠাচ্ছে। সেই রাজ্যপাল মমতার পছন্দের না অপছন্দের, তা থেকে আগামী লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রণকৌশল সম্পর্কে কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। মমতাই–বা কীভাবে সেই কৌশল মোকাবিলার পরিকল্পনা করছেন, তা–ও খানিকটা হয়তো বোঝা যাবে এর মধ্য দিয়েই।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা