বিশ্লেষণ
মোদির মস্কো মিশনের নেপথ্যে থাকা ‘চীন ফ্যাক্টর’
গত মাসে জি-৭ বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেছিলেন। এ মাসে মোদি রাশিয়া সফর করলেন। মোদির এই রাশিয়া সফরের তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন ব্রহ্ম চেলানি
পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম রাশিয়া সফর করলেন। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মস্কোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ঠিক রাখার বিষয়টিকে দিল্লি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
ভারত যে মুহূর্তে সূক্ষ্মভাবে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছে এবং চীনের বিরুদ্ধে যায় যুক্তরাষ্ট্রকে এমন সব কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে, সে মুহূর্তে দিল্লি-মস্কোর এ সম্পর্ককে ভারতের নেতারা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলে মনে করছেন।
২০০০ সালে রাশিয়া ও ভারত বার্ষিক সম্মেলন শুরু করেছিল। সেইমতো চলে আসছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২১ সালে দিল্লি সফর করার পর ২০২২ সালে মোদির মস্কো সফরের কথা ছিল।
কিন্তু ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন অভিযান শুরু করার পরিপ্রেক্ষিতে (এ অভিযান যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অংশীদারদের রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপে উৎসাহিত করেছিল) মোদি তাঁর নির্ধারিত সফর পিছিয়ে দিয়েছিলেন। (অবশ্য ২০২২ সালে উজবেকিস্তানে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময় সম্মেলনের এক ফাঁকে মোদি পুতিনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। সেই আলাপে তিনি পুতিনকে ‘এটি যুদ্ধ করার সময় নয়’ বলে পরামর্শও দিয়েছিলেন)।
তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এত দিন ধরে চলার পর এখন এটি স্পষ্ট যে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও সেটি সম্ভব হয়নি। রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়নি, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়নি।
যাহোক গত মাসে তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হওয়ার পর মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর দীর্ঘ বিলম্বিত মস্কো সফরে যাবেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে, মোদির মস্কো সফর মানে কিন্তু ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যুতে রাশিয়ার পক্ষ নেওয়া নয়। কারণ, গত মাসেই মোদিকে জি-৭ বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বুকে জড়িয়ে ধরতে দেখা গেছে এবং তাঁর সঙ্গে মোদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেছেন।
মোদি মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সরাসরি রাশিয়ার পক্ষ না নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কৌশলগত সুবিধাগুলো আদায় করতে চান। পাশাপাশি ভারত যে তার স্থায়ী পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীনতায় কোনো আপস করে না, সেই বার্তাও তিনি এর মধ্য দিয়ে দিতে চান।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে কয়েক দশক ধরে সহায়তা দিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজের হাতে তাদের সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিপক্ষ তৈরি করেছে, তা নয়, বরং তাদের ভুলের কারণেই এখন আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সামরিক শত্রুর সঙ্গে ভারতকে যুঝতে হচ্ছে। এর একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হিমালয়ে চীন-ভারতের সামরিক স্থবিরতা, যা এখন পঞ্চম বছরে পড়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের শুরু ১৯৭১ সালে, যখন ভারত সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় ছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) যেমন করেই হোক স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করছিল।
ওই সময় প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশিকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল, দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছিল এবং প্রায় এক কোটি লোক ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পেছন থেকে সহায়তা করে যাচ্ছিল। নিক্সন প্রশাসন এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছিল।
যখন ইয়াহিয়া খানের সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালায়, তখন নিক্সন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে পাকিস্তান থেকে বেইজিংয়ে গোপন সফরে পাঠিয়েছিলেন (যে সফরটি পরে একটি বিখ্যাত গোপন সফর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে) এবং কিসিঞ্জারের ওই সফরের জের ধরে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিক্সন নিজে চীন সফর করেছিলেন।
হোয়াইট হাউসের একটি বৈঠকে কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানকে চীনের সঙ্গে তাঁর (ইয়াহিয়ার) ‘আস্তিনে লুকানো ছুরি’ কূটনীতির সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ যাতে স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারে, সে জন্য নিক্সন চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে একটি সামরিক ফ্রন্ট খোলার জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
হোয়াইট হাউসের টেপ এবং নথিপত্র অনুসারে, ভারতীয় সীমান্তের দিকে সেনা জমায়েত করার জন্য চীনাদের উৎসাহ দেওয়াই ছিল কিসিঞ্জারের কাজ। শয়তানি চালের দিক থেকে নিক্সন এতটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, ভারতে একটি ‘গণদুর্ভিক্ষ’ দরকার।
এ ধরনের প্রতিকূলতার মুখে পড়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্রেমলিনের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি করেন। ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশিদের সহায়তা করার জন্য যখন ১৩ দিনের একটি সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল, তখন রাশিয়ার সঙ্গে করা সেই চুক্তির ধারাগুলো চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে একটি সামরিক ফ্রন্ট খোলা থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করেছিল।
ভারতের এ অভিযানে নিক্সন অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁর সে অসন্তোষ সুস্পষ্ট ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপকে সীমিত করে নিক্সন শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে সক্ষম একটি নৌ টাস্কফোর্স মোতায়েন করেছিল।
এই ‘গানবোট কূটনীতি’ ভারতকে ১৯৭৪ সালে তার প্রথম ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ওই পরমাণু পরীক্ষার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর প্রযুক্তি–নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তিন দশক ধরে ওই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
আজ ভারত রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি গভীর ও অধিকতর বিস্তৃত সম্পর্ক বজায় রাখছে। কিন্তু নিক্সন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার যে সূচনা করে গিয়েছিলেন, তা আজও যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তাড়া করে ফিরছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে কয়েক দশক ধরে সহায়তা দিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজের হাতে তাদের সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিপক্ষ তৈরি করেছে, তা নয়, বরং তাদের ভুলের কারণেই এখন আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সামরিক শত্রুর সঙ্গে ভারতকে যুঝতে হচ্ছে। এর একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হিমালয়ে চীন-ভারতের সামরিক স্থবিরতা, যা এখন পঞ্চম বছরে পড়েছে।
চীন ও ভারতের এই দ্বন্দ্ব মস্কোর সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টার পেছনের একটি মূল প্রেরণা। ভারত বিশ্বাস করে, মস্কো ও দিল্লির সম্পর্ক জোরদার হলে চীনকে বাগে রাখা সহজ হবে।
রাশিয়ার ভূখণ্ড চীনের চেয়ে অনেক বড় এবং তার বিশাল অঞ্চলজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল মজুত রয়েছে। তার হাতে রয়েছে একটি বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রাগার, ক্রমবর্ধমান মহাকাশ শক্তি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা।
যেহেতু মধ্য এশিয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়া এবং আর্কটিক অঞ্চলকে চীন ও রাশিয়া উভয়ই তাদের কৌশলগত উঠান মনে করে। সে কারণে এই দুই দেশ পরস্পরের ‘প্রাকৃতিক’ প্রতিযোগী হয়েই ছিল।
এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়া ও চীন ক্রমবর্ধমানভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ত্রুটির কারণেই এই দুই বিপরীত শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান নৈকট্য তৈরি হচ্ছে।
পারস্পরিক সুবিধার জন্য গড়া এই মৈত্রী (পুতিন ও সি চিন পিং যাকে ‘অন্তহীন অংশীদারি’ বলে অভিহিত করেছেন) শুধু যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলক পতনকে ত্বরান্বিত করছে, তা-ই নয়; তাদের এই সম্পর্ক ভারতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ইতিমধ্যে চীন রাশিয়ার জন্য একটি অর্থনৈতিক প্রাণসঞ্চারক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বিনিময়ে রাশিয়ার উন্নত সামরিক প্রযুক্তি চীনে প্রবেশাধিকার লাভ করেছে। অথচ এই সামরিক অস্ত্র তারা আগে শুধু ভারতের কাছে বিক্রি করত। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থেকে চীনের চেয়ে কোনো দেশই বেশি লাভবান হতে পারছে না।
এ অবস্থায় কাউকে না কাউকে অবশ্যই রাশিয়া-চীন সম্পর্কে ফাটল ধরাতে একটি ছেনি বা গোঁজ চালাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে দায়িত্ব না নেওয়ায় এখন চীনের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ না হতে রাশিয়াকে বোঝানোর দায় ভারতের ওপর এসে পড়েছে।
ভাগ্য ভালো, এটি বাস্তবতা থেকে খুব বেশি দূরের কোনো ভাবনা নয়।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কারও যুদ্ধ বেধে গেলে রাশিয়া তাৎক্ষণিকভাবে সামরিক সহায়তা নিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের পাশে দাঁড়াবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও তা ভারতের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তবে যেহেতু চীনের হাতের মুঠো থেকে ছুটে যাওয়া মক্কেল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে বোঝা যাচ্ছে, পুতিন তাঁর মতো করেই হাঁটতে ইচ্ছুক। তিনি মোটেও চীনের মন জুগিয়ে চলতে চান না।
এখন ভারতের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান ঘটাতে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করা। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার দিকে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করবে। আর সেটি হলে তাইওয়ানের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে।
ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ