বছর দশেক আগে জনসভায় নরেন্দ্র মোদি নিয়মিত বুক চাপড়ে হুংকার দিতেন, ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি আমার। কাউকে পরোয়া করি না!’
ব্যক্তি হিসেবে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়ে মোদি তিনবেলা গৌরব করুন। তাতে কেউ আপত্তি করতে আসবে না। তিনি তাঁর চেয়ে কয়েক ইঞ্চি কম মাপের বুকের ছাতিওয়ালা কারও সঙ্গে হম্বিতম্বি করলেও হয়তো তৃতীয় কারুর বলার কিছু নেই।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির যাকে বাধ্যতামূলকভাবে পরোয়া করার কথা ছিল, তার নাম কূটনৈতিক শিষ্টাচার, তার নাম অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব।
কিন্তু আজ (১৬ ডিসেম্বর) আমাদের মহান বিজয় দিবসে তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে যে পোস্ট দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতির গরম তিনি বাংলাদেশের মানুষকেও দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
সকালে মোদি তাঁর পোস্ট করা বার্তায় বলেছেন, ‘আজ বিজয় দিবসে আমরা সেই সাহসী সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই, যাঁরা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে সুরক্ষিত করেছে এবং আমাদের গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসামান্য বীরত্ব ও অবিচল মানসিকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। তাঁদের আত্মত্যাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে চিরদিনের জন্য গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’
আমরা জেনেছি, রেসকোর্সে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বুলেটসহ পিস্তল জমা দিতেই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিজয় ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল। সেই বিজয় ছিল বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ বিজয়। ভারত সেই বিজয়ের সহযোগী ছিল, ভাগীদার ছিল না।
নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে।
সেই বিজয়ের সহযোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিজয়ের আনন্দে ফি বছর ভারত শামিল হতেই পারত।
ভারতের শামিল হওয়াটা বাংলাদেশের বিজয়ানন্দকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারত।
কিন্তু আমরা দেখলাম, ১৬ ডিসেম্বরে আমরাও বিজয় দিবস উদ্যাপন করি; ভারতও ‘বিজয় দিবস’ উদ্যাপন করে। ভারতের সেই ‘বিজয় দিবস’ উদ্যাপনে থাকে ভারত আর পাকিস্তানের যুদ্ধের গল্প।
সেই গল্পে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নেই।
সেই গল্পে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসী অভিযানের গল্প নেই।
বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর হাড় হিম করা লড়াইয়ের গল্প নেই। আছে শুধু ভারতের সেনাদের বীরোচিত অবদানের আখ্যান।
ভারত সেই ১৯৭২ সাল থেকে ‘বিজয় দিবস’ উদ্যাপন করে আসছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তখন থেকেই ভারতের রাজনীতিকেরা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখিয়ে আসছেন।
এটি যথেষ্ট আপত্তিকর বিষয় হলেও বাংলাদেশের দিক থেকে এত দিন ভারতের প্রচারিত ভাষ্যকে তেমন একটা গায়ে মাখা হয়নি।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরা এই দিবসে বাণী দিলে সেখানে অন্তত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা থাকত।
কিন্তু মোদির টুইট পড়লে মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য’ বলেই মনে হবে। পুরো পোস্টের কোথাও ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি পর্যন্ত নেই।
এই ‘বিজয় দিবস’ যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, মোদির টুইট পড়ে তাও বোঝার উপায় নেই।
শুধু কি মোদি? ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে যে টুইট করেছেন, তার ভাষাও একই রকমের।
মুর্মু লিখেছেন:
‘বিজয় দিবসে আমি আমাদের সাহসী সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যাঁরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অপরাজেয় সাহস প্রদর্শন করে ভারতের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। কৃতজ্ঞ জাতি আমাদের বীর শহীদদের চূড়ান্ত ত্যাগ স্মরণ করে, যাঁদের গল্প প্রতিটি ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করে এবং যাঁদের গল্প জাতীয় গর্বের উৎস হিসেবে চিরকাল থেকে যাবে।’
একটি দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বার্তা সেই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা। এই নেতারা যখন এই বার্তা দেন তখন স্পষ্ট হয়ে যায়, ভারত রাষ্ট্রটি বাঙালি জাতির একটি শ্রেষ্ঠ অর্জনের গৌরবকে রীতিমতো ছিনতাই করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের এই মনোভাবকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি সরাসরি হুমকি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’-এর মানচিত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেই ম্যাপে আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকেও ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এটি প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি কত বড় আঘাত তা তাদের উপলব্ধি করতে না পারার কথা নয়।
পার্লামেন্টের দেয়ালে ওই মানচিত্র সেঁটে রাখার পেছনে কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তা বাস্তবায়নকারী দল বিজেপির নেতাদের যে দুরভিসন্ধির কথা মাঝে মাঝে আলোচনায় উঠে আসে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতি মুর্মুর আজকের টুইট তাকে আরও জোরালো করবে।
আশার কথা, বাংলাদেশের মানুষ মোদির টুইটের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করছেন তরুণেরা। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে আমাদের সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাও আছেন।
যেখানে একটা খাঁটি প্রতিবাদই একটা বায়ান্ন; একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধাই যেখানে একটা একাত্তর; সেখানে কোটি বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদে মোদির বার্তা ভেসে যাবে, এতে আর সন্দেহ কী?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]