করোনাকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরকার অসমতা ও সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হয়, ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা পুনর্বিবেচনা করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। এটি সামাজিক-আবেগগত শিক্ষার (এসইএল) তাৎপর্য ও মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে এবং আমাদের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে উৎসাহিত করে।
মহামারিকালে শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণের অভিজ্ঞতা-সম্পর্কিত একটি গবেষণায় শিশুদের সুস্বাস্থ্যের ওপর স্কুল বন্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে রুটিন না থাকার কারণে হতাশা, শারীরিক ও সামাজিক কার্যক্রম কমে যাওয়া এবং বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ কমে আসা। এতে আরও দেখা যায়, স্কুল বন্ধ ও খোলার পর শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণগুলো প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে, বিশেষত নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা শিশুদের মধ্যে।
গবেষণাটিতে অংশগ্রহণকারী এক শিক্ষক বলেন, ‘(ক্লাসরুমে) শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, কোনো কিছুতেই অংশ নিতে চায় না, সব সময় ভাইরাসের ভয়ে ভীত থাকে, কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না, সহপাঠীদের সঙ্গে খুবই কম যোগাযোগ করত। এমন পরিস্থিতি দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। ভেবে পাই না, এমতাবস্থায় আমার কী করা উচিত বা তাদের কীভাবে সহায়তা করব।’ আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক একই ধরনের কথা বলেছেন।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচলিত পদ্ধতিতে দেখা যায়, সাধারণত সমস্যা শুরু হওয়ার পর সহায়তার খোঁজ করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো শারীরিক সমস্যার মতো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। আবার অনেকেই মানসিক রোগ বা সমস্যাগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে এক করে দেখেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করে জানায়, মানসিক স্বাস্থ্য মানসিক রোগ না থাকার চেয়েও বেশি কিছু। এটি অত্যন্ত জটিল ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া, যেখানে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে আলাদারকম অভিজ্ঞতা হয়, নানা রকম অসুবিধা ও মানসিক চাপের ওপর এটি নির্ভর করে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এর সামাজিক ও ক্লিনিক্যাল ফলাফলও ভিন্ন হয়।
ডব্লিউএইচওর মতে, মানসিক সুস্থতার একটি পর্যায় হলো মানসিক স্বাস্থ্য, যা জীবনের চাপ নেওয়া, সক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারা, ভালোভাবে শেখা ও কাজ করা, এমনকি সমাজে অবদান রাখার ক্ষেত্রেও মানুষকে সক্ষম করে তোলে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের যথার্থ বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমাদের আনন্দ, আবেগগত সুস্থতা, আত্ম-সহানুভূতি বা এ রকম ছোট ছোট বিষয়ে যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আমাদের শিশুদের জন্য এসইএল নিশ্চিত করার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে। যেখানে স্কুল-পরিসীমার ভেতর ও বাইরে—দুই জায়গাতেই শিশুদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্তৃত দক্ষতা ও গুণাবলির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সাক্ষরতা ও গাণিতিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শৈশব থেকেই স্থিতিশীল ও আবেগীয় বুদ্ধিবৃত্তি তৈরি করতে স্কুলগুলোর উচিত মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়গুলো স্বীকৃতি দেওয়ার একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা।
আর তা অর্জন করার ক্ষেত্রে শিশুদের এসইএল ও জীবন-সম্পর্কিত সমস্যাগুলোয় কাজে লাগবে এমন দক্ষতায় পারদর্শী হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বসংবলিত একটি সুষ্ঠু কারিকুলাম।
একই ভাবে, শিক্ষক ও শিক্ষক-প্রশিক্ষকদেরও তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও সুস্থতা সমুন্নত রাখার জন্য সহায়তা ও উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। এমনকি তাদের সাংস্কৃতিকভাবে সম্পর্কিত কৌশল ও ট্রমা বুঝতে পারার শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা উচিত। তবে এসব উদ্যোগ কোনো কাজেই আসবে না, যদি শিক্ষকেরা আবেগগত দিক থেকে সুস্থ না থাকেন, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকার পরও তারা তা কাজে লাগাতে পারবেন না।
বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানসিক পুঁজির (মেন্টাল ক্যাপিটাল) মধ্যে সংযোগের ওপর আলোকপাত করা হয়। মানসিক পুঁজির পরিমাণ কম হলে উৎপাদনশীলতা কমে আসে, আর্থিক খরচ বেড়ে যায় ও ভবিষ্যতের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার মানেই হচ্ছে সহযোগিতা চাওয়ার কৌশল রপ্ত করা, যা ঝুঁকি কমিয়ে আনবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৩ নম্বর লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকর জীবন ও সুস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে বিশেষভাবে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুহারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আত্মহত্যা প্রতিরোধের মতো মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়গুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে নিরলস মনোযোগ, পর্যাপ্ত তহবিল ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত একটি সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা সুস্থ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে এমন একটি প্যারাডাইমের দিকে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণকে বিবেচনায় রাখা হবে। এই সমন্বিত নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও অংশীজনদের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, যেন তারা স্থানীয় বাস্তবতার নিরিখে কনটেন্ট ও পদ্ধতি ডিজাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। সুস্বাস্থ্যের উপায় হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা শুধু উন্নয়ন দক্ষতার জন্যই জরুরি নয়, বরং একটি উন্নত জীবনের জন্যও প্রয়োজনীয়।
ড. মাঞ্জুমা আখতার সহকারী অধ্যাপক ও হেড অব অ্যাকাডেমিকস, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি