রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও দার্শনিক আয়ন র্যান্ডের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘একজন ব্যবসায়ী ভুল করলে ক্ষতিটা তাঁরই হয়; আর যদি কোনো আমলা ভুল করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আপনি।’
একজন ব্যবসায়ী আপনাকে তাঁর পণ্য কিনতে বাধ্য করতে পারেন না। এ কারণে যদি তিনি ভুল করেন বা কোনো ক্ষতির মুখে পড়েন, তাহলে এর পরিণতি তাঁকেই ভোগ করতে হয়। কিন্তু কোনো আমলা ভুল করলে ক্ষতিটা হয় করদাতাদের। কারণ, ব্যবসায় খদ্দের চূড়ান্ত বস হলেও সরকারে করদাতারা বস নন।
এনডিএর নেতৃত্বাধীন সরকারে নরেন্দ্র মোদির নতুন মেয়াদের এক মাসে তাঁর আগের মেয়াদের ত্রুটিবিচ্যুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত মাসটি মোদি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দুই সপ্তাহ পর উত্তরবঙ্গে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষ হয়েছিল। এর পরপরই মেডিকেল ছাত্ররা এনইইটি পরীক্ষায় অনিয়মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করেছিলেন।
এখানকার আমলাতন্ত্র যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ ব্যবস্থা আনুগত্যকে পুরস্কৃত করে, মেধাতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করে এবং অদক্ষতার প্রসার ঘটায়। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে দুর্বল করে দিতে থাকে। এখানকার আমলাতন্ত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কাজ করে এবং বিরোধীদের নিপীড়ন করে।
সবচেয়ে খারাপ খবর এসেছে অবকাঠামো খাত থেকে। অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে মোদির গৌরব নিয়ে সবচেয়ে বড় তামাশা করেছে বর্ষা মৌসুম। প্রবল বর্ষণে গুয়াহাটি, জবলপুর ও রাজকোটের বিমানবন্দরে ছাদের সমস্যা বা ছাউনি ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। দিল্লি বিমানবন্দরে ছাউনি ধসে একজনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। গত এক মাসে বিজেপি ও এর শরিক জেডিইউ শাসিত বিহারে ১৫টির বেশি সেতু ভেঙে পড়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সরকারি অবকাঠামোর ত্রুটির কারণে ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ৮ হাজার ৭৫৬ জন মারা গেছে।
মোদি একজন ‘জাতি নির্মাতা’ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। গত তিন বছরে মোদির ১০ হাজার কোটি ডলারের বার্ষিক অবকাঠামো ব্যয় সত্ত্বেও এখন তাঁর প্রকল্পগুলোর বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত ১০ বছরে নিশ্চিতভাবে মোদি যে বড় বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন, সেটি হলো পদ্ধতিগত সংস্কার।
নিজের এবং ভারতের মহৎ ভাবমূর্তিকে মোদি এতটাই ফোকাস করেছেন যে তার নিচে তাঁর উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। ‘অমৃতকাল’ ও ‘বিশ্বগুরু’ নামে দুটি উচ্চাভিলাষী রূপকল্পের প্রচার মোদির বাগাড়ম্বরের বড় উদাহরণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো একটি দেশ শুধু বাগাড়ম্বর বা বক্তৃতাবাজি করে চলে না; বরং দেশ চলে ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর। আর এই ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রযন্ত্র চলে আমলাতন্ত্রের হাত ধরে।
ভারতে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রায়ই সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর প্রতিফলন দেখা যায়। সেখানে ক্ষমতা থাকে কেন্দ্রীভূত এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া থাকে অস্বচ্ছ। ২০১২ সালে হংকংভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভারতের আমলাতন্ত্রকে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বলে উল্লেখ করেছে। এখানকার জনমনের উপলব্ধি হলো, আমলারা তাঁদের কাজকারবারের জন্য খুব কমই দায়ী থাকেন। এটি গোটা ব্যবস্থাকে দায়িত্ব পালনে দায়িত্বহীনতাকে উৎসাহিত করে।
এখানকার আমলাতন্ত্র যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ ব্যবস্থা আনুগত্যকে পুরস্কৃত করে, মেধাতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করে এবং অদক্ষতার প্রসার ঘটায়। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে দুর্বল করে দিতে থাকে। এখানকার আমলাতন্ত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে কাজ করে এবং বিরোধীদের নিপীড়ন করে।
উদাহরণস্বরূপ, এখানে সরকারের পক্ষে রায় দেওয়ার এবং কাজ করার পর বিচারপতি ও সরকারি কর্মচারীদের বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও (রাজন গগৈ) এ তালিকা থেকে বাদ যাননি।
আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির মধ্যকার এই গাঁটছড়া করদাতাদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেয়। ২০১৭ সালে ভারত সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন ও ভাতা বাবদ ১০ দশমিক ১৮ ট্রিলিয়ন রুপি ব্যয় করেছে, যা জিডিপির ৮ দশমিক ১৫ শতাংশের সমান।
এই ব্যয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রতিরক্ষা বরাদ্দের চেয়ে বেশি। অথচ সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা ও অর্জন সে তুলনায় সন্তোষজনক নয়। অবকাঠামো ও সরকারি পরিষেবাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাওয়া ব্যর্থতা আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
সেতুধস, বিমানবন্দর দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনা ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস আমলাতন্ত্রের ত্রুটিগুলো উন্মোচন করছে। ভারতীয় আমলাতন্ত্র এখন শাসক দলের সহায়তাদানকারী গোষ্ঠীর নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে এটি এখন করদাতাদের জন্য বোঝা এবং অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
● রবি কান্ত একজন কলাম লেখক এবং এশিয়া টাইমস–এর নয়াদিল্লি সংবাদদাতা
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত