১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্টের ঘটনা। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ক্রেডিটব্যাংকেন নামের একটি ব্যাংকের কার্যালয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল একজন পলাতক আসামি। জ্যান ওলসন নামের ওই অস্ত্রধারী ব্যাংকের চার কর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে।
ওলসনের দাবি, তার একজন কারাসঙ্গীকে মুক্ত করে দিতে হবে, পাশাপাশি তাকে সাত লাখ মার্কিন ডলার ও একটি গাড়ি দিতে হবে। পুলিশ তার সব দাবিই পূরণ করেছিল। ২৮ আগস্ট উদ্ধার হওয়ার আগপর্যন্ত মোট ৬ দিন কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখে ওই অস্ত্রধারী। এ ঘটনায় শোরগোল পড়ে যায় সারা পৃথিবীতে।
এখানে মজার ব্যাপার হলো, উদ্ধার করার পর দেখা গেল জিম্মিকারীর প্রতি একধরনের সহানুভূতি জন্মে গেছে পণবন্দী ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাঁরা এমনকি জিম্মিকারীর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দিতে পর্যন্ত রাজি হননি। উপরন্তু জিম্মিকারীকে যখন কারাগারে পাঠানো হয়, তখন তার মুক্তির জন্য অর্থ সংগ্রহও শুরু করেন ওই কর্মকর্তারা।
এমন অবস্থায় পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ডাক পড়ে মনোচিকিৎসক নিলস ব্যাজরটের। তিনি জিম্মিকারীর সঙ্গে জিম্মিদের ভালো সম্পর্ক হয়ে ওঠার এই প্রবণতাকে প্রথম স্টকহোম সিনড্রোম হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
ক্ষমতার অসাম্যতা এ ধরনের মনোবৈকল্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং বহু ধরনের ঘটনা ব্যাখ্যায় ধারণাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এই উপসর্গ কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে না থেকে একটা গোটা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে যেতে পারে কি না বা ঐতিহাসিক কোনো রাজনৈতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ধারণাটি প্রযোজ্য হতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন গবেষকেরা।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রকৃতার্থে নাগরিকদের অবস্থা পণবন্দীর মতোই হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে স্বৈরশাসকের প্রতি নাগরিকদের একটা অংশের মধ্যে অন্ধ মোহ তৈরি হয় এবং যত খারাপ পদক্ষেপই স্বৈরশাসক নিক না কেন, অনেকে সেটিকে কল্যাণকর মনে করেন।
একনায়কের পতনের পর এই উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একধরনের হাহাকার ও কাতরতা অনুভব করেন। যেটা কি না পরবর্তী সময় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বৈরশাসকেরা সাধারণত জনগণকে জিম্মি করে ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করেন, দৃশ্যমান উন্নয়নে মনোযোগ দেন এবং নাগরিকদের নানাভাবে গর্বিত অনুভব করানোর চেষ্টা করেন। মানবিক মর্যাদা, নাগরিক অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া সত্ত্বেও এসব প্রচেষ্টা নাগরিকদের একটা অংশের মধ্যে একনায়কের প্রতি অনুরক্ততা তৈরি করে।
সামগ্রিকভাবে স্বৈরতন্ত্র একটা দমবন্ধ করা সময়ই। থমাস স্ট্রেন্টজ ব্যাখ্যা করেন, মানুষ যখন জিম্মি হয়ে পড়ে তখন তার প্রধান লক্ষ্য থাকে কোনোমতে বেঁচে থাকা।
জিম্মিকারীকে ঘৃণা করা বা প্রতিবাদ করার কথা সে ভুলে যায়। এর মধ্যে ন্যূনতম ভালো আচরণ বা নিদেনপক্ষে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই জিম্মিকারীর প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ও ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়। স্বৈরতন্ত্রেও ব্যাপারটা এভাবেই কাজ করে।
স্বৈরশাসকেরা সাধারণত জনগণকে জিম্মি করে ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করেন, দৃশ্যমান উন্নয়নে মনোযোগ দেন এবং নাগরিকদের নানাভাবে গর্বিত অনুভব করানোর চেষ্টা করেন। মানবিক মর্যাদা, নাগরিক অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া সত্ত্বেও এসব প্রচেষ্টা নাগরিকদের একটা অংশের মধ্যে একনায়কের প্রতি অনুরক্ততা তৈরি করে।
মিসরের একনায়ক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের কথাই ধরা যাক। মোবারক তাঁর ৩০ বছরের শাসনামলে এক আদর্শ স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন। মতপ্রকাশের ন্যূনতম স্বাধীনতা ছিল না, জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল অত্যধিক, নাগরিকদের ফোন কল, ই-মেইল, আড্ডা, সমাগম সবকিছুই ব্যাপকভাবে নজরদারি করা হতো।
মোবারকের বিরুদ্ধে সামান্যতম বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেলেই গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে দেওয়া হতো দণ্ড। এসবই পরিচালনা করত এসএসআইএস নামের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা। বলা হয়ে থাকে, মিসরের মোট জনসংখ্যার ৬-১০% ছিল এই সংস্থার চর। এতটাই বিস্তৃত ছিল এর গোয়েন্দা জাল। মোবারক নির্বাচনের আয়োজন করতেন, তবে তা ছিল আগাগোড়া এক মিথ্যা নির্বাচন।
মোবারকের শাসনকাল এতটা নিপীড়নমূলক হওয়া সত্ত্বেও ২০১১ সালে মোবারকবিরোধী বিক্ষোভের প্রাক্কালে কয়েক হাজার লোককে মোবারকের পক্ষে সমাবেশ করতে দেখা গিয়েছিল।
এখানে যে সুবিধাভোগী এলিটরাই ছিল তা নয়; বরং নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকেরাও ছিলেন, যাঁরা ৩০ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন। বিপ্লবোত্তরকালেও জনগণের একটা অংশের মধ্যে মোবারক শাসনের স্মৃতিকাতরতা রয়ে গিয়েছিল।
গবেষক লইস স্পিয়েট দেখান, কীভাবে মিসর ও ইরাকি জনগণের একটা অংশ স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো দিয়ে পুরোপুরি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল। জনগণের অবস্থা ছিল সত্যিকার অর্থেই পণবন্দীর মতো।
দ্বিতীয়ত, মোবারক সমাজের একটা শ্রেণির ওপর আরেকটা শ্রেণিকে প্রাধান্য বিস্তার করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। যাঁরা কি না রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বদৌলতে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান ছিলেন।
তৃতীয়ত, সত্যিকার সংবাদমাধ্যম বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না বলে দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জনগণের ধারণা ছিল সামান্য।
সর্বোপরি, সর্বত্র চলত শাসকের বন্দনা। মিডিয়ায় সর্বদা হাজির থাকতেন মোবারক। তাঁকে ঘিরে একটা ধর্মতান্ত্রিক আবহ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে মোবারককে দেখানো হতো অবতার হিসেবে। দেশের সব ইতিবাচক অর্জনের কৃতিত্ব দেওয়া হতো তাঁকে। এসবের মাধ্যমে কেবল যে সুবিধাভোগীরাই মোবারকের অনুরক্ত হয়ে ওঠেন, তা নয়; বরং নিম্নবিত্ত ও বঞ্চিত মানুষদের একটা অংশের মধ্যেও মোবারককে ত্রাতা হিসেবে দেখার চেতনার ভ্রান্তি তৈরি হয়।
লইস দেখান, মোবারক যা যা করেছেন, তার সবই সাদ্দাম হোসেনও করেছেন। তবে বাড়তি ছিল কর মওকুফ, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত টিউশন ফি তুলে দেওয়া। ফলে প্রচণ্ড রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক ও ভীতিকর পরিবেশ সত্ত্বেও সাদ্দামের এসব কল্যাণমূলক পদক্ষেপ তার প্রতি জনগণের একটা অংশের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করতে পেরেছিল।
স্টকহোমের জিম্মিকৃত ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে তাদের জিম্মিকারীর প্রতি এভাবেই সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল। কারণ, জিম্মিকারী তাদের জানে মেরে ফেলেনি, স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দিয়েছে, একজন যখন শীতে কাঁপছিলেন, তখন জিম্মিকারী নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও তাঁরা সব সময়ই মৃত্যুর হুমকির মুখেও ছিলেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে স্বৈরশাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, তাতে মোবারক ও সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরতন্ত্রের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই বিরাজ করছিল। উপরের বর্ণনা পড়ার সময় আশা করি প্রতিটি বিবেচক পাঠকই তা মিলিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি।
এ লেখায় মূলত যে বিষয়টি ইঙ্গিত করতে চাই, সেটা হলো, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনেও বাংলাদেশি জনগণের একটা অংশ স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ইতিমধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার পর সরকার ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কথায় বা কাজে পান থেকে চুন খসলেই কেউ কেউ বলছেন, ‘আগেই তো ভালো ছিলাম।’ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসও তৈরি হয়েছে বটে।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর ৫-৬ আগস্ট টিকটকে বেশ কিছু ব্যবহারকারীকে হাসিনার জন্য আফসোস করতে দেখেছি। একজন ব্যবহারকারী সত্যি সত্যিই কান্না করছিলেন এবং বলছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি না, তবু শেখ হাসিনার জন্য আমার কেন যেন খুব খারাপ লাগছে।’ ওই ভিডিওটিই আমাকে লেখাটা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
গণবিদ্রোহের মুখে যখন কোনো সরকারের পতন ঘটে, তখন নতুন সরকারের প্রতি জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। অনেক দিন ধরে নিষ্পেষিত হওয়ার কারণে নতুন ব্যবস্থায় তারা রাতারাতি পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। অনেক জিনিস দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব হলেও এমন বহু বিষয়ই আছে, যা একটা ভালো সরকারও রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারে না। অর্থনৈতিক বিষয়াদি সম্ভবত এর মধ্যে অন্যতম।
অতিরিক্ত ও কিছুটা অবাস্তব প্রত্যাশা থাকার কারণে বিপ্লবোত্তর সময়ে জনগণ দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে শিগগিরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে অতিপ্রত্যাশা উদ্ভূত হতাশা ও স্টকহোম সিনড্রোমের বহিঃপ্রকাশ ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তথ্যসূত্র:
১. https://www.history.com/news/stockholm-syndrome
২. In Love With an Autocratic Ruler: Introduction of The Stockholm Syndrome as Historical Phenomenon With Egypt and Iraq as Case Studies by Lois Spliet
৩. M. Adorjan e.a., 'Stockholm Syndrome as Vernacular Resource', The Sociological Quarterly 53 (2012) 3, 454-474, 457.; J. M. Carver, 'Love and Stockholm Syndrome: The Mystery of Loving an Abuser', Journal (2007) 1-11, 1.
৪. T. Strentz, 'The Stockholm Syndrome: Law Enforcement Policy and Ego Defenses of the Hostage', Annales Ne
হাসান আল মাহমুদ সাংবাদিক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]