লুলার মুক্তিতে আরেক গোলাপি ঢেউয়ের আশা

লুলা দা সিলভা

পুরো নাম লুইজ ইন সিও লুলা দা সিলভা। তবে দুনিয়া চেনে লুলা দা সিলভা নামে। লুলা লাতিন আমেরিকার আধুনিক সমাজবাদী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ। মেহনতি মানুষের নেতা। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন আধিপত্যবাদ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লুলা ও তাঁর গণমানুষের সেবাভিত্তিক স্বাধীন নীতির বিরোধিতা করে আসছিল। মার্কিনদের এই অসন্তুষ্টি লুলাকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করে জেলে পুরেছিল। উদ্দেশ্য ছিল ব্রাজিলের প্রাকৃতিক সম্পদ হস্তগত করে লুলা প্রণীত কর্মসূচিগুলো থামিয়ে দেওয়া। কিন্তু সগর্বে ফিরে এসেছেন লুলা।

লাতিন আমেরিকার গত কয়েক শ বছরের ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্যের মতোই রক্তাক্ত। যেখানেই গণমানুষের পক্ষের লোকজন ক্ষমতায় এসেছেন, সেখানেই মার্কিনরা হয় সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে নতুবা আদালতকে ব্যবহার করে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আর কাজটা করেছে তারা গণতন্ত্র, উন্নয়ন আর স্বাধীনতার নামে। হালের ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া কিংবা কয়েক দশক আগের চিলি যার জ্বলন্ত উদাহরণ। লাতিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশ ব্রাজিলও মার্কিনদের এই ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র খেল থেকে মুক্তি পায়নি। নতুন শতাব্দীর শুরুতে লুলা ডি সিলভা আর দিলিমা রুসেফের অত্যন্ত কার্যকরী দারিদ্র্য নির্মূল কর্মসূচি যখন ব্রাজিলের গরিব মানুষের জীবন বদলে দিতে শুরু করে, তখনই পশ্চিমাঘেঁষা বুর্জোয়া গোষ্ঠী বেঁকে বসে। শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা।

ক্রমাগত ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ উত্থাপন শুরু করে বুর্জোয়া গোষ্ঠী আর গণমাধ্যম।
যখন লুলাবিরোধী জমিন প্রস্তুত হলো, ঠিক তখনই আইনের কলকবজা নিয়ে হাজির হয় ব্রাজিলের বিচার বিভাগের মার্কিন মদদপুষ্ট একটি অংশ। পরিচালিত হয় ‘অপারেশন কারওয়াশ’। সরাসরি মার্কিন মদদে পরিচালিত এই সংঘবদ্ধ অভিযানের লক্ষ্য ছিল লুলা ও তাঁর দল ওয়ার্কার্স পার্টি। ভোটের রাজনীতিতে লুলা ও তাঁর সঙ্গীদের হারানো যাবে না—এটা বুঝতে পেরেই আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে লুলা ও তাঁর সঙ্গীদের উৎখাতের পরিকল্পনা কষে পশ্চিমারা। ‘অপারেশন কারওয়াশ’-এর প্রধান কুশীলব বিচারক সের্গিও মরো পরে ব্রাজিলের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো সরকারের আইনমন্ত্রী হন। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, দুর্নীতি নয়, বরং লুলাই ছিল তাদের লক্ষ্য। প্রহসনের বিচারে ২০১৭ সালে ২৫ বছরের জেল দেওয়া হয় লুলাকে।

ফৌজদারি আইনে সাজা হওয়ার দরুন ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি লুলা। ১৮ মাসের বেশি জেল খেটে সদ্য মুক্তি পেয়েছেন লুলা।
ব্রাজিলের নিম্নবিত্ত জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে সুদিন এনেছিলেন লুলা। শুরুটা হয়েছিল বোলসা ফেমিলিয়া বা পারিবারিক ভাতা দিয়ে। এই ফর্মুলায় স্বল্প আয়ের অর্থাৎ ৩৫ ডলারের নিচে মাসিক আয় যেসব পরিবারের, তাদের সন্তানেরা যদি স্কুলে যায় এবং অপরাধমুক্ত থাকে, তাহলে সন্তানপ্রতি ৭০ ডলার ভাতা প্রদান করা হতো। (দেখুন, দ্য ইকোনমিস্ট, জুলাই ২০১০)। এই প্রকল্প ব্রাজিলের নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু করে। হ্রাস পায় শিশু অপরাধ।

২০১০ পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি পরিবার তথা পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছিল, যা তৎকালীন হিসাবে ব্রাজিলের প্রতি ছয় পরিবারের একটি। পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন, এই বিশাল দারিদ্র্য বিমোচনে লুলাকে খরচ করতে হয়েছিল ব্রাজিলের জিডিপির মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে সর্বনিম্ন মজুরি ১০০ ডলার থেকে ২০০ ডলারে উন্নীত হয়েছিল। একই ধরনের পরিবর্তন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে নেওয়া হয়েছিল (দেখুন, লুলা অ্যান্ড হিজ পলিটিকস অব কানিং: ফ্রম মেটাল ওয়ার্কার টু প্রেসিডেন্ট অব ব্রাজিল)। এই কর্মসূচিগুলো লুলাকে এতই জনপ্রিয় করে তুলেছিল যে যখন ২০১১ সালে লুলা অফিস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ৯০ শতাংশের ওপর। যার দরুন লুলাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বলে অবহিত করেছিলেন ওবামা।

২০২২ সালের প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে লুলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে লুলার এই প্রত্যাবর্তনে লাতিন আমেরিকায় আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনে সুদিন ফিরবে নিঃসন্দেহে। সালভাদর আয়েন্দের পথ ধরেই ২০০০ সালের শুরুর দিকে লাতিন আমেরিকা গরিব মেহনতি মানুষের বন্ধুদের নির্বাচিত করা শুরু করে। এই আন্দোলন পিংক টাইড হিসেবে পরিচিত। এই সামাজিক এবং মার্কিনবিরোধী আন্দোলন ১৯৯৯ সালে হুগো শাভেজ, ২০০৩ সালে লুলা, ২০০৬ সালে ইভো মোরালেস ও ইকুয়েডরের রাফায়েল কোরেয়াকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। ভূখণ্ড ভিন্ন হলেও নির্বাচিত সবাই ছিলেন গণমানুষের নেতা, পুঁজিবাদ আর মার্কিন শোষণের বিরুদ্ধে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিনরা ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধ, সেনা ক্যু ঘটিয়ে ভেনেজুয়েলার মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং বলিভিয়ায় মোরালেসের নির্বাচনকে বাতিল করতে সফল হয়েছে। এই সব ঘটনার দরুন শ্বেতাঙ্গ এবং মার্কিন আধিপত্যবাদবিরোধীদের মধ্যে একধরনের হতাশা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু লুলার প্রত্যাবর্তন হতাশা মুছে নবপ্রাণ এনেছে। ২০২১ সালে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনগুলোতে লুলার উপস্থিতি মার্কিনপন্থীদের অবস্থান নড়বড়ে করে দিতে পারে। আবার তাই আরেক নতুন পিংক টাইডের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে। লুলার এই আগমনের প্রভাব শুধুই লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে আটকে থাকবে না। নিশ্বাস ছাড়বে চীন, রাশিয়া, ইরান আর তুরস্ক।

লুলার উত্তরসূরি দিলমা রুসেফকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ২০১৬ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। রুসেফের অপসারণের বিষয়টি মার্চেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, যখন তাঁর কোয়ালিশনের সবচেয়ে বড় দল ব্রাজিলিয়ান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট পার্টি প্রেসিডেন্টের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। মুভমেন্ট পার্টি মার্কিন মদদে যে কাজটি করেছিল, একই কাজ ২০১৩ সালের মিসরের সৌদি-সমর্থিত আল নুর পার্টিও করেছিল। এক হঠকারী সিদ্ধান্তের দরুন স্বৈরাচারী সিসির হাতে আটকে গেছে মিসর আর ব্রাজিল, আটকে গেছে পশ্চিমের বাহাবা পাওয়া বলসোনারোর হাতে। আগ্রহী পাঠকেরা মনে করতে পারবেন ২০১৬ সালে ব্রাজিল থেকে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে তুরস্কেও একটি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল। ব্রাজিলের গণমানুষের সরকারকে আইন পরিষদ ব্যবহার করে উৎখাত করা হয়েছিল আর তুরস্কে ব্যবহার করা হয়েছিল সেনাবাহিনীকে। ব্রাজিলের মানুষ সেদিন হেরে গিয়েছিল মার্কিন আধিপত্যবাদের কাছে, কিন্তু তুরস্কের মানুষ হারেনি।


লুলা, মাদুরো, মোরালেসরা নিজ দেশের গণমানুষের উন্নতির জন্য শ্রম দিয়েছেন। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাতে জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনকে বাতিল করে নিজেদের কর্মসূচিকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। কারণ, এসব প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর হয় না বরং অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদে পশ্চিমা স্বার্থ নিশ্চিত হয় আর মানুষকে একটি নির্দিষ্ট চক্রে বেঁধে ফেলা হয়। বৃহৎ অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আফ্রিকা মহাদেশে জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক যে দারিদ্র্য কর্মসূচি পালন করে আসছে, তাতে দারিদ্র্য তো হ্রাস হয়ইনি বরং মুক্ত বাণিজ্যের নামে প্রায় সব প্রাকৃতিক সম্পদ পশ্চিমের হস্তগত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার যে মাটি কাস্ত্রো, আয়েন্দে, শাভেজ, লুলা আর দিলিমাদের জন্ম দিয়েছে, সেই মাটিতে সাম্রাজ্যবাদ খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। মার্কিনরা গণতন্ত্রের নামে গণমানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর শোষণের বৃত্তে আটক রাখা কঠিন হবে।

রাহুল আনজুম আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক