তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধন করে ভারতকে আবার নতুন মন্ত্রে জাগিয়ে তোলা হবে—এই আশ্বাস দিয়ে ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বর্ম পরে ক্ষমতায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সেই আশ্বাস তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দারুণভাবে আশা জাগিয়েছিল।
মোদি ভোটারদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁর যুগ হবে ‘আচ্ছে দিন’-এর যুগ। তিনি ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’ নীতি গ্রহণ করা, ‘সাবকা সাথ সবকা বিকাশ’ শীর্ষক সমন্বিত উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো—এ রকম বিষয়ের দিকে জোর দিতে চেয়েছিলেন। ভোটাররা তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এই দফায় মোদি তাঁর সেই আগের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তিনি ভালো করেই জানতেন, এই সব প্রতিশ্রুতি যেহেতু তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি, তাই সেগুলো আবার মনে করিয়ে দিলে সেটি তাঁর জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এবার ওই দিকে না গিয়ে মোদি খুব সংক্ষিপ্ত পথ ধরলেন। তিনি রব তুললেন, ভারতের ভেতরে ও বাইরে শত্রুরা গিজগিজ করছে। তিনিই একমাত্র ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা নেতা, যিনি তাঁর দলবল নিয়ে চৌকিদারের মতো দেশকে সন্ত্রাসী, অনুপ্রবেশকারী, জাতীয়তাবাদবিরোধী ও হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণে বাধাদানকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন। তাঁর এই কৌশল কাজে দিয়েছে। মোদির এই ‘খাকি’ প্রচারণা তাঁকে ২০১৪ সালের চেয়েও বড় বিজয় এনে দিয়েছে। লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তাঁর দল পেয়েছে ৩০৩টি। এ ছাড়া তাঁর জোটের অন্য শরিকদের হাতে এসেছে আরও ৫০টি আসন।
২০১৯ সালের এই নির্বাচন থেকে বিরাট শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। গত দফায় মোদি অনেকগুলো আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি জেনেও আবার ভোটাররা তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?
এর একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হলো, আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ভাবমূর্তিসম্পন্ন মানুষ মোদির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজেপির লাখ লাখ সাইবার যোদ্ধা মোদিকে অবতারের সম্মান দিয়ে প্রচার চালিয়ে গেছে;
হুমকি–ধমকিতে ভয় পেয়ে ‘মূলধারার’ সংবাদমাধ্যম মোদির সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছে, জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের ৫ হাজার ৬০০ কোটি রুপি খরচ করে রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা গণমাধ্যমে মোদির প্রতি পদক্ষেপের খবর প্রচার করা হয়েছে। জনগণকে বোঝানো হয়েছে, এই প্রধানমন্ত্রী একেবারে ‘ভিন্ন জাতের’। আসলেই তিনি ভিন্ন। তাঁকে এমন এক ভিন্ন উচ্চতায় তুলে ধরা হয়েছে, যা তাঁর ওপর দেবত্ব আরোপের শামিল।
এটা নিশ্চিত যে দলের পক্ষ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে মোদির ওপর একধরনের দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। লাখ লাখ ভোটারকে ফোনে যোগাযোগ করে দলে ভেড়ানো হয়েছে। পোলিং বুথ কমিটি নির্বাচনের আগে থেকেই সতর্ক ছিল, তাদের সহায়তায় ছিলেন স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোদিকে মহান ধর্মীয় নেতা হিসেবে ভোটারদের কাছে তুলে ধরেছেন।
ব্যক্তি মোদির প্রচার এমনভাবে করা হয়েছে যে ভারতের ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার মনে করেছেন বিজেপি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে কি পারবে না, সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করা তাঁদের ধর্মীয় দায়িত্ব। বিজেপির পক্ষ থেকেও ভোটারদের এই ধারণা দেওয়া হয়েছে। অনেক আসনে নির্বাচনী প্রচারের সময় পোস্টারে বিজেপি প্রার্থীদের ছবি দেওয়া হয়নি। পোস্টারে শুধু পদ্মফুল ও মোদির ছবি ছিল। এর মধ্য দিয়ে ভোটারের মনের মধ্যে মোদিকে অতিমানব হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এটা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন ঘটনা যে ভোটাররা বিজেপির কাজ ও সাফল্যের দিকে না তাকিয়ে শুধু ধর্মীয় জাতীয়তার কথা ভেবে তাদের সমর্থন দিয়েছে। ২০১৪ সালে মোদির কর্মসংস্থানের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে যে বেকার তরুণ বিজেপিতে ভোট দিয়েছিলেন, এই ২০১৯ সাল নাগাদ সে চাকরি না পাওয়ার পরও কেন বিজেপিকে ভোট দিলেন? এমন হতে পারে যে তিনি মনে করছেন, ভারতে মুসলমানের উত্থানের আশঙ্কা আছে এবং এই সংকট থেকে মোদিই দেশকে ‘বাঁচাতে’ পারবেন। মোদি যতবার বলেছেন, ‘নতুন ভারত!’ ততবার এই ভোটারদের মনের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী প্রাচীন ভারতের ছবি ফুটে উঠেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী