১০ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সেই উপলক্ষে এসকেএফ আয়োজিত প্রথম আলোর সহযোগিতায় অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনার বিষয় ছিল এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। এদিন অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন তিনজন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। প্রথমজন হলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী। ছিলেন বাংলাদেশ শিশু ও কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি হেলাল উদ্দিন আহমেদ। আরও অংশ নিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এম এম জালাল উদ্দিন।
মানসিক রোগে কোনো জীবাণু খুঁজে পাওয়া যায় না। আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মহামারি—নানা কারণে অসমতার শিকার হলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সেটা প্রকট হলে মানসিক রোগ হতে পারে। আমাদের সমাজে ধর্ম, বর্ণ, আর্থিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থা—এসব নানা কিছু নিয়ে অসমতা ও বৈষম্য রয়েছে। দিন শেষে এগুলো আমাদের মানসিকভাবে আক্রান্ত করে, বিপর্যস্ত করে। মানসিক সমস্যা আর রোগ কিন্তু এক নয়। মানসিক স্বাস্থ্য যখন খারাপ হয়, তখন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো মানসিক সমস্যার চিকিৎসা বা নিরাময় না হলে তা একসময় প্রকট হয়ে রোগে দেখা দেয়।
মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের তৈরি অসমতা ছিল। এশিয়ায় নানা কারণে সেটি আরও বেশি। নগরায়ণের ফলে আমরা নিজেদের অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। আর যুদ্ধবিগ্রহ তো প্রায়ই চলমান মানবসভ্যতায় জেগে ওঠে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের ঝনঝনানি তো আছেই। সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টার্শিয়ারি—সব ধরনের মানসিক সেবা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অথচ মানসিক চিকিৎসাসেবা নিয়ে আমাদের একটা অবহেলা আছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাপ্রত্যাশী তিন লাখ মানুষের বিপরীতে মাত্র একজন মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন। সংখ্যাটা মোটেই সন্তোষজনক নয়।
আমাদের দেশে মানসিক চিকিৎসাসেবা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে কাজ করছেন এমন চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় তিন শ। আর সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত সব মানুষ মিলে তাঁদের সংখ্যা হাজারের কম। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ প্রযোজনায় যে জরিপ হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, বয়স্কদের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যায় আক্রান্তের হার ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। আর তরুণদের বেলায় তা ১৩ ভাগ। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে অন্তত ৩ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় আছেন বা মানসিক রোগে আক্রান্ত। অথচ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিপরীতে আমাদের চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র এক হাজার!
নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, ক্ষমতাবান, ক্ষমতাহীন, প্রযুক্তি যাঁদের আছে, আর যাঁদের প্রযুক্তি নেই—এই সমস্ত ক্ষেত্রে একধরনের অসমতা আছে। মানসিক অভিঘাত নিরাময়ে আমাদের সম্পদ খুবই সীমিত। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রত্যেকের অধিকার। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সাধারণভাবে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। এক, লঘু মানসিক সমস্যা। এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্তদের সংখ্যাটাই বেশি। আর এটা খুব খরচসাপেক্ষ বা প্রযুক্তিনির্ভর, এমনটাও নয়। সহমর্মিতার সঙ্গে এই সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অ্যাংজাইটি, ডিজঅর্ডার, আত্মহত্যার প্রবণতাতে মানসিক সেবা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে হবে। অনলাইনেই প্রেসক্রিপশন দিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা যায়।
অনেকেই সামাজিক নানা কারণে মানসিক অসুখ গোপন করতে চান। এই স্টিগমা দূর করতে হবে। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর দেখা হলে তাঁরা ওই রোগ নিয়ে আলাপ করেন। কিন্তু কোনো মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে কোনো রোগীর দেখা হলে রোগী ওই টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যান। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। বাংলাদেশে সরকারি মেডিকেলের সংখ্যা ৩৬। এর ১৬টিতেই কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিভাগ নেই। আর এই বিষয় না পড়েই এমমিবিএস শেষ করে চিকিৎসক হয়ে যাওয়া যায়! অথচ গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিষণ্নতা মানুষের উৎপাদনমুখিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানে আমাদের যা করণীয়, তা-ই করতে হবে।