প্রতিবারের মতো এবারও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য—অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য। এই বিশেষ দিনে অটিজম নিয়ে কিছু কথা জানাতে চাই। বিশেষ করে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বাবা–মায়েদের বিষয়গুলো জানা খুবই জরুরি। অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। এতে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণত তাদের বয়স অনুযায়ী জ্ঞানীয় বিকাশ হয় না। তারা বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান, ভাষাগত দক্ষতা অর্জন বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারঅ্যাকশন) করতে পারে না। এই লক্ষণগুলো শুধু বাচ্চাদের মধ্যেই পাওয়া যায়।
অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটা শিশু মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। তাই শিশুর বয়স একটু একটু করে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেতে থাকে এই লক্ষণগুলো। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা অন্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা আচরণ করে থাকে। যেমন বারবার একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করা, অস্থির আচরণ করা, চোখে চোখ না করা। এগুলো সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। অটিজমের এই লক্ষণগুলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা যদি বুঝতে পারেন, বাচ্চাকে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা যেতে পারে। তাই এই বিষয়ে মা–বাবার সচেতনতাই অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে।
অটিজম স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। তাই এতে আক্রান্ত শিশুর চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনের জন্য অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতির দরকার হয়। এ চিকিৎসাপদ্ধতিতে স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। যেহেতু রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তাই মা–বাবার জন্য ‘প্যারেন্টাল কাউন্সেলিং’ ভীষণ জরুরি। কেননা, সন্তানের এ রকম অবস্থা দেখে তাঁরা হতাশায় ভোগেন, ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে শিশু মনোবিদ, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি এই বাচ্চাদের খাবারের তালিকাতেও কিছু বিধিনিষেধ আছে। এই সম্পর্কে যথাযথ গাইডলাইন জানতে একজন পুষ্টিবিদেরও আবশ্যক ভূমিকা রয়েছে।
মা-বাবার সচেতনতামূলক পদক্ষেপগুলো
অনেক সময় আমরা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মায়েদের কাছ থেকে শুনে থাকি যে বাচ্চা দুই থেকে আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারত। দু–একটা ছড়া বলতে পারত। তারপর ধীরে ধীরে এখন আর একদম পারে না। ভাষাগত বিকাশ একটা ‘ইউ শেপ কার্ভ’–এর হয়। মানে উল্টো কার্ভ। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় পাঁচ মাসে শিশুর ভাষার বিকাশের প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়। আর ‘পিক পিরিয়ড’ হচ্ছে তিন বছর। ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে ভাষাগত বিকাশ ঘটানো যেতে পারে।
তিনটি বিষয় খেয়াল রেখে বাচ্চার জন্য ইন্টারভেনশন প্ল্যান করতে হবে। বাচ্চার সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। প্রতিনিয়ত বাচ্চার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাকে যোগাযোগে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সে যাতে আপনাকে অনুকরণ করে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাঁদের দেওয়া টেকনিকগুলো ধৈর্যের সঙ্গে পালন করতে হবে।
দেখা–শোনা–স্বাদ–গন্ধ
দেখা, শোনা, গন্ধ ও স্বাদ নেওয়া—প্রতিদিনের আলাদা আলাদা অনুভূতি। প্রতিটি অনুভূতির আলাদা লক্ষণ থাকে। যেমন একটা শিশু যদি স্পর্শ সহ্য করতে না পারে, তার মানে হচ্ছে টেকটাইলে হাইপার সেনসিটিভিটি থাকতে পারে। আবার শিশুটির যেকোনো চাপ নেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি থাকে, তবে দেখা যায় তার হাইপার সেনসিটিভিটি থাকতে পারে। এগুলো দৈনিক আচরণে প্রকাশ পায়। আর এ জন্যই শিশুর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ‘সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি’। এ থেরাপি শিশুর অনুভূতির সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে আপনার শিশুকে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
শিশুর সঙ্গে খেলুন
কিছু গবেষণামূলক তথ্য থেকে দেখা গেছে যে নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রমে অটিজম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিশুরা সামাজিক বিকাশ লাভ করে। শিশুরা অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে। তবে বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশুর মাংসপেশির সমন্বয় ও কার্যক্ষমতা দুর্বল থাকে। হাতের আঙুলের মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে অনেকেই পেনসিল ধরতে পারে না বা খুব সূক্ষ্ম কাজগুলো করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে শিশুর আঙুলের সমন্বয় ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাকে কাদামাটি বা ময়দার খামি দিয়ে খেলতে দিন। নিজেও তার সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠুন আর তার প্রশংসা করুন। শিশুকে বেশি বেশি খেলাধুলায় আগ্রহী করতে হবে। যেমন বল ছুড়ে দেওয়া, বাস্কেটে বল ছুড়তে বলা—এই একটি কাজই বারবার করতে দিন। আর বলুন, হচ্ছে, হবে। এভাবে অনুপ্রাণিত করুন।
শিশুর সঙ্গে ছবি আঁকুন, তাদের মনোযোগ বাড়ান
প্রতিদিন একই নিয়মে একটি কাজ করলে শিশুর মনোযোগ বাড়বে। মাংসপেশির কার্যক্ষমতাও বাড়বে। ফলে শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং সামাজিকভাবে অন্যদের সঙ্গে মিশতে সহজ হবে। শিশুর সঙ্গে রং নিয়ে খেলার জন্য দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন। এ সময়ে তার সঙ্গে মেতে উঠতে পারেন নানা রকমের খেলায়। একটা ত্রিভুজ এঁকে তাতে রং করাতে দিন। খেয়াল রাখতে হবে যে শিশু যেন ধীরে ধীরে সময় নিয়ে কাজটা শেষ করে। এর ফলে তার মনোযোগ বাড়বে। মনে রাখবেন শিশুদের একমাত্র কাজ হলো খেলা। খেলার মাধ্যমেই শিশু ধাপে ধাপে স্বাভাবিক বিকাশ লাভ করে। কথা বলতে হবে, গান ও ছড়া শোনাতে হবে, ছবির বই দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট ও একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সাহায্য দরকার।
মা–বাবারও প্রয়োজন কাউন্সেলিং
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য একমাত্র মায়েরাই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে থাকেন। তাঁরা অনেক সময় পরিবারের থেকে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি আর সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন। সে কারণেই তাঁরা হতাশা, বিষণ্নতায় ভোগেন। নিজের যত্ন নিতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, অন্যকে সুস্থ করার জন্য সবার আগে নিজের সুস্থতা জরুরি। সে কারণে ‘প্যারেন্টস কাউন্সেলিং’ নেওয়াটা বিশেষভাবে জরুরি। এতে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
শিশুর প্রশংসার বিকল্প নেই, তুলনা চলবে না
মা–বাবা বা বাড়ির সবাইকে শিশুদের সব কাজের প্রশংসা করতে হবে। আদর, উৎসাহ আর উদ্দীপনা দিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে। ভালোবাসা দেখাতে হবে। হাসিখুশিভাবে তার সামনে থাকতে হবে। টয়লেট ক্লিনিং শেখাতে হবে। নিজের জামাকাপড় নিজেই পরা শেখাতে হবে। কখনোই তাঁর এই শিশুকে অন্য স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। বিধাতার আশীর্বাদ মনে করতে হবে তার এই আজীবনের জন্য জন্মানো নিষ্পাপ সন্তানটিকে। সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। দেখবেন আপনার নিরলস প্রচেষ্টা এবং ইতিবাচক চিন্তার আলোকছটা ওর আচরণে প্রতিফলিত হবে। তাই নিজে উদ্বুদ্ধ হবেন, আপনার পরিবারের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবেন আপনার সন্তানের যত্ন নিতে এবং সব কাজে তাকেও উৎসাহিত করতে হবে।
লেখক: শিশু মনোবিদ, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা