একসঙ্গে যখন অনেক বিপদ এসে পড়ে
বলা হয়, বিপদ কখনো একা আসে না। যখন আসে, দলবল নিয়ে আসে। আসলেই কি বিপদ-আপদ দল বেঁধে আসে? হ্যাঁ, বিষয়টি অনেকটাই সত্যি। যেমন পরিবারের কোনো সদস্য হঠাৎ হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে গাড়িতে তোলার পর হয়তো দেখা গেল কিছুতেই চালু হচ্ছে না গাড়ি। বিকল্প ব্যবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখা গেল পকেটে মানিব্যাগটাই নেই! এ রকম বিপদের ওপর আরও বিপদে অনেকেই পড়েন। কিন্তু কেন এমনটা হয়? এটা কি কেবলই কাকতালীয়, নাকি এর কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা রয়েছে?
কেন বিপদের ওপর বিপদ
অনেক সময় জীবনে চলে আসে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। হুট করে ঘটে যায় এমন ঘটনা, যা আমাদের কল্পনার বাইরে। সেই পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে আমাদের মনোজগতে তৈরি হয় আলোড়ন। তৈরি হয় মানসিক চাপ বা স্ট্রেস। স্ট্রেসের প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় আপৎকালীন হরমোন।
এই আপৎকালীন হরমোনের প্রভাবে হঠাৎ বিপদে ‘ফাইট অর ফ্লাইট (লড়ো অথবা ভাগো)’ প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেয় আমাদের মন। ‘বিপদ মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়া (ফাইট)’ কিংবা ‘বিপদ থেকে নিরাপদে চলে যাওয়া (ফ্লাইট)’ যেকোনোটিই ঘটতে পারে। এ সময় চিন্তার প্রক্রিয়া যদি এলোমেলো হয়ে যায়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে প্রতি পদক্ষেপে ভুল হতে থাকে, আর ঝামেলা বাড়তে থাকে। ফলে বিপদের ওপর চলে আসে আরেক বিপদ। ধরা যাক শুরুর উদাহরণটির কথা, কাছের মানুষের অসুস্থতায় তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গিয়ারের লক না খুলে বা হ্যান্ডব্রেক বন্ধ রেখেই গাড়ি চালু করতে গিয়ে বিপত্তি, এরপর দ্রুত আরেক গাড়িতে ওঠার সময় প্রথম গাড়িতে মানিব্যাগ ফেলে রেখে যাওয়ায় শূন্য পকেটে হাসপাতাল! আবার অনেকে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গাড়ির ব্রেকের বদলে এক্সিলারেটরে চাপ দেওয়ায় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। বিপজ্জনিত মানসিক চাপের কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, মনোযোগ কমে যাওয়া, বিবেচনাবোধ লুপ্ত হওয়া বা কমে যাওয়া, হতাশ হয়ে পড়া, ভুলে যাওয়া বা রেগে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আর এর সবকিছু ডেকে আনতে পারে আরেকটি বিপদ। এভাবেই দল বেঁধে আসে বিপদ।
কী করবেন
‘বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখুন’ কথাটি বলা যত সহজ, প্রকৃত বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করা ততটা সহজ নয়। তবে কয়েকটি বিষয় চর্চা করলে বিপদ কাটিয়ে উঠতে এবং পরবর্তী বাড়তি বিপদের ঝুঁকি অনেকাংশেই এড়ানো যায়—
বিপদ এসেছে? ঘনঘন শ্বাস না নিয়ে, বড় করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন। দেহে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে রাখুন।
হড়বড় করে কথা বলবেন না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কথা বলুন। আপনার মুখের কথা আর শব্দচয়ন বিপদের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
অপ্রয়োজনীয় চিৎকার, হইচই বা ছোটাছুটি করে অতিরিক্ত শক্তিক্ষয় করবেন না। বিপদের ধরন বা মাত্রা বুঝতে কিছুটা সময় নিন।
নিজেকে আগে নিরাপদ রাখুন। আরেকজনকে সাহায্য করতে গিয়ে বা বিপদ থেকে পালাতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করবেন না। নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে রেখে বিপদ মোকাবিলার পরিকল্পনা করুন।
অহেতুক কৌতূহল বর্জন করুন। হয়তো একটি বিপদের ঘটনা ঘটেছে, নিছক মজা দেখতে গিয়ে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না।
প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য চান। ফোন করে, চিৎকার করে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহায্য প্রার্থনা করতে পারেন, তবে মনে রাখবেন, অপ্রয়োজনীয় চেঁচামেচি আপনার শক্তিক্ষয় করবে।
যেকোনো বিপদে জরুরি প্রয়োজন না হলে মুঠোফোন ব্যবহার করবেন না। বরং ফোনের চার্জ জমিয়ে রাখুন। মুঠোফোনে আপনার পরিবারের সদস্যদের নাম ও সম্পর্ক লিখে তাদের নম্বর সংরক্ষিত রাখুন। সেই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, আপনার কর্মস্থল আর বাসস্থানের নিরাপত্তাকর্মী আর লিফটম্যানের নম্বর যেন মুঠোফোনে থাকে।
কিছু জরুরি ফোন নম্বর, নিকটজনের নাম–ঠিকানা, ফোন নম্বর কাগজে লিখে মানিব্যাগে রাখার অভ্যাস করুন।
মনে রাখবেন, আপনার ওপর যে বিপদ এসেছে, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ থেকেও হয়তো অনেক মানুষ উদ্ধার পেয়েছে। আত্মশক্তি বজায় রাখুন। বিপদে হতাশ হলে বিপদ আরও বাড়বে।
ভয়, ভয় বাড়ায় আর সাহসে বাড়ে সাহস। আপনার বিপদে অন্যকে আতঙ্কিত করবেন না। আতঙ্কিত মানুষ ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, উদ্ধার তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করে। তাই অন্যকে ভয় দেখালে আপনারই ক্ষতি।
আপনার বাসস্থান, কর্মস্থল আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নকশা জেনে রাখুন। কোথায় সিঁড়ি, বেজমেন্ট, জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আর পানি আছে, নিজ দায়িত্বে তা জেনে রাখুন।
বিপদের সময় ‘মিনিমালিস্ট’ হন। অপ্রয়োজনীয় বোঝা, জামাকাপড় ইত্যাদি নিয়ে ছোটাছুটি করবেন না। বিপদের ধরন বুঝে আপনার মূল্যবান সামগ্রীর মায়া ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকুন। যেমন ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডের সময় টাকাপয়সা বা গয়নার ঝুলি খোঁজাখুঁজির চেয়ে আগে নিজেকে নিরাপদ করুন।
নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করলে অপরকে সাহায্য করার চেষ্টা করুন। নিজে বিপদগ্রস্ত হয়ে অপরকে সাহায্য করতে গেলে বিপদের পরিমাণ ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে। এ জন্যই উড়োজাহাজে বলা হয়—জরুরি সময়ে নিজের অক্সিজেন মাস্ক আগে পরিধান করে, তারপর অপরকে সাহায্য করুন।
বিপদ কাটানোর প্রক্রিয়ায় নিজেকেও ধন্যবাদ দিন। নিজের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। এই প্রতিকূলতা আর বিপদের মধ্যেও আপনার ওপর অর্পিত ছোট-বড় কাজগুলো সাধ্য অনুযায়ী করে নিজেকে আর কাছের মানুষদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছেন বলে নিজেকেও ধন্যবাদ দিন।
প্রাথমিক চিকিৎসার সাধারণ তথ্যগুলো মাথায় রাখুন। বাড়িতে ও অফিসে ফার্স্ট এইড বক্স দৃশ্যমান রাখুন।
বিপদের মুহূর্তে যা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা নিয়ে চিন্তা করে, বিহ্বল হয়ে নিজের উৎকণ্ঠাকে বাড়াবেন না, মেধার অপচয় করবেন না। তার চেয়ে যেসব বিষয়ের ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগী হন, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করুন।
নিজের আবেগ প্রকাশ করার চেষ্টা করুন। অপরের আবেগকে বুঝতে শিখুন। ‘আপনিই ঠিক, বাকি সব ভুল’—এ ধরনের অহংবোধসম্পন্ন অসংবেদনশীল বিশ্বাস আপনার বিপদকে আরও বাড়াবে।
বিপদে দুঃখ পেয়ে, ভেঙে পড়ে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন না। অনাহার আপনার শরীরে গ্লুকোজ আর খনিজ লবণের পরিমাণ কমিয়ে দেবে, আপনাকে যা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেবে। ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিপদ আরও বাড়বে।
যে কারও জীবনে নানা ধরনের বিপদ হতে পারে, এটা মাথায় রেখে নানান ধরনের বিপদের জন্য শারীরিক–মানসিক প্রস্তুতি নিন। কোন বিপদে কী করবেন, মাঝেমধ্যে ভাবুন। মনের মধ্যে আগে থেকেই ছক কষে রাখুন। বাড়িতে বা অফিসে ফায়ার ড্রিল, দুর্যোগের মহড়া হলে বিষয়টি হালকাভাবে না দেখে গুরুত্বের সঙ্গে নিন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করুন।
বিপদে শৃঙ্খলা মেনে চলুন। অতি উৎসাহী এলোমেলো আচরণ বিপদ আরও বাড়াবে। বিপদে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তির নির্দেশনা মেনে চলুন। সবকিছুতে নাক গলানোর অভ্যাস থাকলে বিপদের সময় এটি আপনার জন্য আরও বিপদের কারণ হতে পারে।
বিপদের সময় যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষিত বা বিশেষজ্ঞের উপদেশ বা সাহায্য নেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তা গ্রহণ করুন।
যেকোনো ধরনের গুজব তৈরি বা সেগুলো প্রচার থেকে বিরত থাকুন। একটি বিপদের পর গুজব প্রচারিত হলে পর্যায়ক্রমে আরও বিপদ বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
বিপদ কেটে যাওয়ার পর, বিপদ কাটার প্রক্রিয়াগুলো বারবার স্মরণ করুন। প্রক্রিয়ার কোথায় কোনটি সঠিক ছিল আর কোনটি ভুল ছিল, মূল্যায়ন করুন। এটি ভবিষ্যতে বিপদ মোকাবিলায় সাহায্য করবে।
যেকোনো ধরনের বড় বিপদে মনের মধ্যে ক্ষত তৈরি হতে পারে। পরবর্তী সময়ে যা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বাধা তৈরি করে। তাই বড় বিপদের পর মনঃসামাজিক সেবা গ্রহণ করুন। এমনকি উদ্ধারকর্মী, চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক—যাঁরা সেই বিপদটি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের মনের মধ্যেও ক্ষত তৈরি হতে পারে, হতে পারে আঘাত–পরবর্তী মানসিক চাপজনিত সমস্যা বা ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ (পিটিএসডি)। পরবর্তী যেকোনো বিপদ মোকাবিলায় পিটিএসডিতে ভোগা মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই বড় দুর্যোগ বা বিপদের পর পিটিএসডির বিষয়টি মাথায় রেখে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারে।