ভোজ্যতেল দিয়ে শুরু, বাংলাদেশে এখন আদানির নানা রকম ব্যবসা
ভোজ্যতেলের ব্যবসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ শুরু করে ভারতের আদানি গ্রুপ। সেটি ১৯৯৩ সালের কথা। তারপর বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ আরও বেড়েছে, ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটেছে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত নানা খাতে। মূলত বাংলাদেশে গ্রুপটির অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত প্রায় আট বছরে।
আগামী মার্চ মাস থেকে ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল ও টার্মিনালসহ বেশ কিছু খাতে আদানির বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে বলে গ্রুপটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের কোন কোন খাতে ভারতীয় এই ব্যবসায়ী গ্রুপের বিনিয়োগ, বিনিয়োগের পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে আগ্রহ রয়েছে, তা জানতে আদানি গ্রুপ এবং ঢাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম আলো কথা বলেছে। ই-মেইলের মাধ্যমে তারা এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের ও আলোচিত ব্যক্তি গৌতম আদানির রয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সম্প্রসারণও ঘটেছে বহুগুণ। তবে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চের এক প্রতিবেদনের পর সমালোচনার মুখে আদানি গ্রুপ বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারিয়েছে। ফলে গৌতম আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনীর অবস্থান হারিয়ে এখন ২৬তম অবস্থানে চলে এসেছেন।
আদানির বিনিয়োগ
দেশের ভোজ্যতেল খাতে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল ও ভারতের আদানি গ্রুপের যৌথ কোম্পানি বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল) ১৯৯৩ সাল থেকে দেশে ব্যবসা করছে। কোম্পানিটি রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা ব্র্যান্ড নামে বাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি করে।
আদানি উইলমারের ২০২১-২২ বছরের বার্ষিক হিসাব অনুসারে, বিইওএল দেশে মোট ২ হাজার ১৫৫ কোটি টাকার ভোজ্যতেল বিক্রি (টার্নওভার) করেছে। তবে এরপরও কর-পূর্ববর্তী ২৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছিল কোম্পানিটির।
ভোজ্যতেল ছাড়াও দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে আদানি গ্রুপ। ভারতের ঝাড়খন্ডে অবস্থিত আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আগামী মার্চ নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।
কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত পুরো বিদ্যুৎ আগামী ২৫ বছর বাংলাদেশ কিনবে, এমন চুক্তি রয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। এ চুক্তিটি হয়েছিল ২০১৭ সালে।
তবে ঝাড়খন্ডের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আদানির প্রস্তাব করা কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবি মনে করে, কয়লার দাম বেশি ধরতে চায় আদানি এবং তা করা হলে বাংলাদেশকে অনেকটা বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা করতে চায় পিডিবি। সে অনুযায়ী আদানির একটি কারিগরি প্রতিনিধিদল আলোচনা করতে ঢাকায় আসবে বলে কথা রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে আদানির বিনিয়োগ
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে অবস্থিত ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের (আইইজেড) উন্নয়নকারী ও পরিচালক (ডেভেলপার) হিসেবে বিনিয়োগ করতে চায় ভারতের আদানি গ্রুপ। ইতিমধ্যে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ডেভেলপার হিসেবে আদানি-বাংলাদেশ পোর্টস লিমিটেডের কাজ হবে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পরিচালনা ও প্লট বরাদ্দ দেওয়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোনের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদানি গ্রুপের সঙ্গে আমাদের চুক্তির শর্তাবলি (টার্মশিট) স্বাক্ষর হয়েছে। এখন তাদের দর-কষাকষির জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা এলে আমরা চুক্তি (ডেভেলপমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।’
বেজার কর্মকর্তারা জানান, চুক্তির শর্তাবলি স্বাক্ষরের পরের ধাপ হিসেবে উভয় পক্ষের সমঝোতায় একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি গঠন করা হবে। এটি চূড়ান্ত হলে চূড়ান্তভাবে আদানির কোম্পানিকে ডেভেলপার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব কাজ চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হতে পারে।
এ ছাড়া ভারতীয় এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য একটি জেটিও স্থাপন করতে চায় আদানি গ্রুপ। তবে এ বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পায়নি তারা।
এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ভারতের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ভারতের একটা শর্ত ছিল যে তারা জেটি করবে। তবে এ বিষয়ে আর কথা এগোয়নি। আদানি গ্রুপের সঙ্গে দর-কষাকষি শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে ২০১৫ সালে দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ভারতীয় এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেয়। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে প্রকল্পের কাজের আওতায় ভারতের মাহিন্দ্রা কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভোজ্যতেলসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত করে খাদ্য তৈরির একটি শিল্পপার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গ্রুপের। এ জন্য বছর তিনেক আগে শিল্পনগরের মধ্যেই পৃথক ১০০ একর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে সেখানে জেটি ও সড়ক না থাকায় কার্যক্রম এগোয়নি।
চট্টগ্রামে টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি গ্রুপ। ২০২০ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এ প্রস্তাব দেয় তারা। এগুলো হলো চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনা ও লালদিয়ায় টার্মিনাল স্থাপন ও পরিচালনা।
তবে এগুলোর মধ্যে সরকার লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি থেকে সরে এসেছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনায় বিনিয়োগ করার অনুমতি পায়নি আদানির কোম্পানি। আর বে টার্মিনালের বিষয়ে আদানি গ্রুপকে এখনো কিছু জানায়নি সরকার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে জানান, পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে আদানি গ্রুপের একটা প্রস্তাব ছিল। তবে সেটা এখন বিবেচনার মধ্যে নেই। টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে পরিচালনার জন্য সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া বে টার্মিনাল তৈরি ও পরিচালনায় আদানি গোষ্ঠীর বিনিয়োগের বিষয়েও এখনো কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ওমর ফারুক।
আরও যেসব বিনিয়োগ পরিকল্পনা
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও বিনিয়োগে আগ্রহ রয়েছে আদানি গ্রুপের। ২০২০ সালের দিকে ২০০ মেগাওয়াটের একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতীয় এ কোম্পানি। তবে তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ প্রস্তাবে অনাগ্রহ দেখানোয় তা আর এগোয়নি বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া সরকারি প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও বিতরণ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ রয়েছে আদানি গ্রুপের। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আদানি গ্রুপের বক্তব্য
বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো নিয়ে জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ভারতের শীর্ষ এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে। তাদের কাছে বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের চলমান বিনিয়োগ প্রকল্প, নতুন পরিকল্পনা, দেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আদানি গ্রুপের চেয়ারপারসন গৌতম আদানির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের আলোচনার অগ্রগতি নিয়েও জানতে চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে আদানি গ্রুপের একজন মুখপাত্র ই-মেইলে জানান, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, খাদ্যপণ্যসহ একাধিক খাতে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে দ্রুত বিক্রি হয় এমন খাদ্যপণ্য (এফএমসিজি) ও বিদ্যুৎ খাতে।
পাশাপাশি আদানি গ্রুপের পরিবহন পরিষেবা আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি পরিকল্পিত ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে টার্মিনালের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ ও চুক্তির বিষয়টি মূল্যায়ন করছে। এ ছাড়া আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের ব্যবসার সুযোগও খুঁজে দেখছে।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনার বিষয়ে আদানির মুখপাত্র জানান, মেধাবী ও বৃহৎ জনশক্তির পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ রয়েছে। এ জন্য প্রতিবেশী হিসেবে আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে বিপুল সুযোগ ও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাময় জায়গা হিসেবে দেখে।
আদানি উৎপাদিত বিদ্যুৎ রপ্তানির বিষয়ে মুখপাত্র জানান, আগামী মার্চ থেকে ঝাড়খন্ডের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হলে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বাড়বে। তখন এই উচ্চ চাহিদা পূরণ করতে পারবে তারা। এতে বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ও বাণিজ্য লাভবান হবে।
বিদ্যমান প্রকল্পগুলো ছাড়া বাংলাদেশের আরও কিছু খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ রয়েছে আদানি গ্রুপের। সেসব প্রকল্প নিয়ে দেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে তারা প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সেগুলো এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে বলে জানান মুখপাত্র।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গৌতম আদানির বৈঠকের অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য জানায়নি গোষ্ঠীটি।