বাংলাদেশে বিরাজমান মানসিক স্বাস্থ্য সংকট ও সম্ভাব্য সমাধান

ড. ইরাম মরিয়ম ও তাবাসসুম আমিনা

‘মানসিক স্বাস্থ্য একটি সর্বজনীন মানবাধিকার’ প্রতিপাদ্যে গত ১০ অক্টোবর পালিত হলো বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার ও ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু জনসংখ্যার সঙ্গে লড়াই করছে বাংলাদেশ। আর এই প্রতিটি কারণই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

যদিও মানসিক স্বাস্থ্য মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত, তারপরও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পেশাজীবীর সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সক্ষমতাও কমে গেছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের সংকটগুলো বুঝতে পারা এবং এই চাপ শিগগির কমবে না—এটা মেনে নেওয়াই উপযুক্ত হবে। পাশাপাশি বর্তমানের সংকটগুলো মোকাবিলা করতে এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি বিকল্প, কার্যকর ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ খুঁজে বের করতে হবে।

জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল আমাদের চিন্তা, আচরণ বা অনুভূতি নয়; বরং কীভাবে মানসিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেব, অন্যদের সঙ্গে মিশব এবং সুস্থ জীবন যাপন করব—সবকিছুতেই এটি প্রভাব বিস্তার করে।

মানসিক স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাইপোলার ডিজঅর্ডার থেকে শুরু করে সিজোফ্রেনিয়া, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি), উদ্বেগ ও বিষণ্নতা। এই বিষয়গুলোয় আমাদের জ্ঞান ও সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ফলে বহু লক্ষণ ও প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করার সম্ভাবনা শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়।

বিশ্বজুড়েই মানসিক স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে বিষণ্নতাকে চিহ্নিত করা হয়। ৫ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ জীবদ্দশায় বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও নাজুক। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা এই রোগে চার গুণ বেশি ভোগেন। এর পেছনে জৈবিক কারণ, লিঙ্গ-নির্দিষ্ট (জেন্ডার-স্পেসিফিক) ভূমিকা, সহিংসতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রভাব রয়েছে।

পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের চারপাশে থাকা সামাজিক কুসংস্কার পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। যাঁরা এসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান, কেবল তাঁরাই নন, তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারও এই সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। তারপরও আমরা এ বিষয়ে তেমন কোনো মনোযোগ দিতে দেখছি না। আর এর মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অবস্থা আরও বেশি সংকটাপন্ন।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক ও উদ্বেগজনক সমস্যা হলো, এই খাতে প্রয়োজনের তুলনায় পেশাজীবীর সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে শূন্য দশমিক ৪৯ জন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছেন বা ব্যক্তিগতভাবে অনুশীলন করছেন। এ ছাড়া প্রতি ১ লাখে শূন্য দশমিক শূন্য ৭ জন মনোরোগ চিকিৎসক, শূন্য দশমিক ১৯ জন নার্স, শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ৭ জন মনোবিজ্ঞানী, শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ২ জন সমাজকর্মী, শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ২ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এবং শূন্য দশমিক শূন্য ২৮ জন অন্যান্য মেডিকেল বা মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

শূন্য দশমিক ১৮২ জন মেডিকেল পেশাজীবী আছেন, যাঁদের মনোচিকিৎসা বিষয়ে সামান্য ধারণাও নেই। বাংলাদেশে ৯১ শতাংশ চিকিৎসা ব্যবধান (ট্রিটমেন্ট–গ্যাপ) রয়েছে, আর মেডিকেল স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করার বিকল্প উপায় না খুঁজলে এই ব্যবধান শিগগির কমে আসার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। একটি সফল ও কার্যকর উপায় অবলম্বন করার আগে সমাজকে বুঝতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, এখানে নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, নিয়ম ও বাস্তবতা রয়েছে।

পরিবারের ক্ষেত্রে যেমন বলা যায়, আমাদের এখানে খুব সাধারণভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা মা–বাবার সঙ্গে বসবাস করেন, যেটা অনেক সমাজেই প্রচলিত নয়। তাই যখন পারিবারিক বাস্তবতা থেকে মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমাদের জন্য তাঁর পরিবারের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারা ও সে অনুযায়ী সমস্যার সমাধান করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে।

অন্য কোনো দেশ বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিচালিত মডেল বা প্রক্রিয়া ভিন্ন আরেকটি দেশ বা প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। এটা বুঝতে পেরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি) ব্র্যাক প্যারাকাউন্সেলর মডেল তৈরি করে। এই মডেলের মূল বিষয়টিই হলো কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য ও মনঃসামাজিক সহায়তাসেবার প্রসার ঘটানো।

আর এ ক্ষেত্রে নিজের কমিউনিটিতে সেবা দেওয়ার জন্য তরুণীদের প্যারাপ্রফেশনাল হিসেবে প্রাসঙ্গিক ও কমিউনিটির চাহিদাগুলো বিবেচনায় রেখে এই মডেল ডিজাইন করা হয়েছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই মডেল সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।

যেহেতু আমরা মানসিক স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত পেশাজীবীদের তীব্র ঘাটতিতে ভুগছি, তাই এ ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করতে পারেন, এমন পেশাজীবী তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দক্ষ মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ধারাবাহিকভাবে দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তুলতে হলে বহু বছরের যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এর চেয়ে বরং আমরা এমন প্যারাপ্রফেশনালদের তৈরি করতে পারি, যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্যে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ও প্রাথমিক সেবা নিশ্চিত করতে পারবেন। তাঁরা সঠিক পরামর্শ–সেবার মধ্য দিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে প্রাথমিক সেবা দিতে পারবেন। যাঁদের আরও উন্নত স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হবে, তাঁদের অন্য কোথাও পাঠানোর (রেফার) ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা উন্নত দেশগুলোর নেওয়া উদ্যোগ ও অনুশীলনগুলো নিজেদের দেশে হুবহু বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজস্ব দেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তা মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিষয়গুলো বোঝা বা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তা আরও জটিল আকার ধারণ করে। বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকার ফলে কুসংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়া, সামাজিক বৈষম্য, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি বিষয় পরিলক্ষিত হয়। তাই মনঃসামাজিক সেবা প্রদানকারী তৈরি করার সময় তাঁদের সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। এসব সেবা প্রদানকারী তৈরি করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষক, সেবাদানকারী, প্রশাসক ও সমাজকর্মীদের মধ্যে সহানুভূতি, মনোযোগের সঙ্গে কথা শোনা এবং কথা শুনেই বিচার না করার মনোভাব বৃদ্ধি করতে হবে; যেন তাঁরাও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ও প্রাথমিক সেবায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। এসব দক্ষতা অর্জন করে একজন ভালো মনঃসামাজিক সেবা প্রদানকারী হিসেবে গড়ে উঠতে হলে প্রয়োজন হয় যথাযথ প্রশিক্ষণের, যা ব্র্যাক আইইডি প্রদান করে প্যারাপ্রফেশনালদের গড়ে তুলেছে। এই দক্ষ প্যারাপ্রফেশনালরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথাযথভাবে সেবা প্রদান করছে। দক্ষ মনঃসামাজিক সেবাদানকারী তৈরি করার মধ্য দিয়ে গুণগত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান সংকট কমিয়ে আনা সম্ভব।

ড. ইরাম মরিয়ম, পিএইচডি: নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

তাবাসসুম আমিনা, পিএইচডি: সহকারী অধ্যাপক এবং লিড অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট টিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি