তাঁর বয়স ৩০–এর আশপাশে। বাড়ি উত্তরের জেলা দিনাজপুরের পলাশবাড়ি। একা একা কথা বলেন, অদ্ভুত সব কল্পনা করেন, কারণ ছাড়াই ভয় পান, হতাশায় ভোগেন, ঠিকমতো ঘুম হয় না। এমনকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
২২ মে সীমান্তবর্তী চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই যুবকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। তিনি এসেছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মনের চিকিৎসা করাতে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে কেন্দ্রটি, নাম ‘মন–স্বাস্থ্য কেন্দ্র’। কেন্দ্রের মধ্যে বসেই নিজের সমস্যার কথা এই প্রতিবেদককে জানালেন তিনি। বললেন, ‘ফলোআপ চিকিৎসার জন্য এসেছিলাম।’
সারা দেশে যখন মানসিক রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল, তখন দেশের এক প্রান্তের সরকারি হাসপাতালের একটি কক্ষে এলাকার মানুষের মনের স্বাস্থ্য ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে আইসিডিডিআরবি। এ উদ্যোগের সঙ্গে আছে দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। উদ্যোগটি ইতিমধ্যে প্রশংসা পেতে শুরু করেছে। সারা দেশে এ রকম ছয়টি কেন্দ্র আছে আইসিডিডিআরবির। সরকার উদ্যোগটির ব্যাপ্তি বাড়ানোর কথা ভাবছে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রটি কীভাবে কাজ করে, কারা চালায়, কেন্দ্রটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেসব খবর রাখেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। এই মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে কোনো না কোনো মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছে এক কোটির বেশি মানুষ। বড় অংশই জানে না যে তাদের সমস্যা আছে। দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার হাসপাতালের ঘাটতি আছে। জনবলের সংকটও তীব্র। চিকিৎসা যা আছে, তা মূলত রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আইসিডিডিআরবির এ উদ্যোগ ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রান্তিক মানুষের মনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এই কেন্দ্রগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ (২০১৯) বলছে, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে মানসিক রোগ বেশি। মানসিক রোগের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ—এসবের প্রকোপ বেশি। মানসিক রোগের প্রকোপ শহরে ও গ্রামে প্রায় সমান।
মানসিক রোগের প্রকোপ উদ্বেগজনক পর্যায়ে থাকলেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে। মানসিক রোগ থাকা ৯১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার বাইরে আছে, অর্থাৎ তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় না বা হাসপাতালে যায় না। মানুষ ‘পাগল’ ভাববে—এই বিবেচনা থেকে বহু মানুষ চিকিৎসা এড়িয়ে চলে। এ ছাড়া দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
কীভাবে শুরু
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা কেন্দ্রগুলোর নাম দিয়েছেন ‘ওয়েলবিয়িং সেন্টার’। পরে সরকারি কর্মকর্তারা নাম দিয়েছেন—‘মন–স্বাস্থ্য কেন্দ্র’। কথা বলে জানা গেছে, এর শুরুটা হয়েছিল করোনা মহামারির সময়। আইসিডিডিআরবির মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী বিজ্ঞানী আনীকা তাসনিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির সময় আইসোলেশন (সঙ্গনিরোধ) ওয়ার্ডে ছিলেন এমন ব্যক্তি অথবা চিকিৎসক ও নার্সের মতো প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোস্তাত্ত্বিক সহায়তার দরকার ছিল। কিন্তু তাঁদের কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দেওয়ার কথা আমাদের মাথায় আসে।’ তিনি আরও বলেন, এ কাজে প্রথমে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি এবং পরে ইউএনএফপিএ এতে যুক্ত হয়। সেবা দিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষানবিশ মনোবিজ্ঞানীরা। তবে প্রান্তিক মানুষের মনের চিকিৎসা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দেওয়ার ধারণাটা প্রথম মাথায় এনেছিলেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমদ এহসানুর রহমান।
২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে থাকা তিন হাজার রোগী এবং আড়াই হাজার চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছিল এ উদ্যোগ থেকে। সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত ও তদারকি হতো আইসিডিডিআরবি থেকে।
এ চেষ্টায় শামিল হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ছয়টি সরকারি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। এগুলো হচ্ছে চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিনাজপুর জেলা হাসপাতাল, নেত্রকোনা জেলা হাসপাতাল, দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাটখিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
কেন্দ্রগুলো কীভাবে চলে
চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দোতলার ছোট একটি কক্ষে এ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কক্ষটি হাসপাতালের অন্য যেকোনো কক্ষের চেয়ে পরিষ্কার, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, দেয়ালে নানা রঙের নানা ধরনের মন ভালো করা ছবি সাঁটানো। টেলিমেডিসিনের জন্য একটি বড় পর্দার কম্পিউটারসহ অন্য সরঞ্জাম রয়েছে। কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য একজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যাঁর বেতন হয় আইসিডিডিআরবি থেকে।
হাসপাতালের কর্মকর্তা ও আইসিডিডিআরবির স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে বা হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোনো রোগীর মানসিক সমস্যা আছে, এমন সন্দেহ হলে রোগীকে এ কেন্দ্রে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ কেন্দ্রে এলে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়। এরপর রোগীর নিবন্ধন হয়। নিবন্ধনের পর রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসা হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আছেন অন্য প্রান্তে তিনটি বড় হাসপাতালে: রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
কোন দিন কোন চিকিৎসক সেবা দেবেন, তা আগে থাকতেই নির্ধারণ করা থাকে। ছয়টি কেন্দ্রের সঙ্গেই এসব চিকিৎসকদের যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা আছে। পুরো আয়োজনটি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আইসিডিডিআরবির মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ। আইসিডিডিআরবির সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সোহেল শমীক প্রথম আলোকে বলেন, রোগীকে পরামর্শ বা রোগীর ব্যবস্থাপত্র প্রতিবার রোগ দেখার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়। রোগীর সব তথ্যই সংরক্ষিত থাকে। ফলোআপে এলে চিকিৎসকের সামনে থাকা টেলিভিশনের পর্দায় রোগীর সব তথ্য, আগে কী চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তা ভেসে ওঠে। তিনি তখন রোগীর সঙ্গে কথা বলে অগ্রগতি বুঝতে পারেন। চিকিৎসায় পরিবর্তন আনার দরকার হলে তা করেন। রোগীর কোনো তথ্যই হারায় না।
দিনাজপুর সদর হাসপাতালেও এ রকম একটি কেন্দ্র আছে। সেখানেও নিয়মিত রোগী আসে। ২২ মে একজন শিক্ষিকার সঙ্গে কেন্দ্রের সামনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁর সঙ্গে ছিল এক কিশোরী। ওই কিশোরীর সমস্যার সমাধান নিতে তিনি কেন্দ্রে এসেছেন।
দিনাজপুর জেলা সিভির সার্জন এ এইচ এম বোরহান উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো দিনাজপুর জেলায় মানসিক রোগের চিকিৎসক মাত্র একজন। সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারেন না। তাঁর ফি অনেক বেশি। মন–স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যে কেউ চিকিৎসা নিতে পারছেন। এই কেন্দ্র দিনাজপুরের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৬টি কেন্দ্রে ৫ হাজার ২৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে নারী ৭৬ শতাংশ, বাকি ২৪ শতাংশ পুরুষ। রোগীদের মধ্যে ১৬ শতাংশের বয়স ১০-১৯ বছর, ৬২ শতাংশের বয়স ২০-৩৯ বছর, ১৮ শতাংশের বয়স ৪০-৫৯ বছর এবং বাকি ৪ শতাংশের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, প্রায় সব বয়সী মানুষ এসব কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিতে আসছে।
এই ছয়টি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীদের মধ্যে মানসিক রোগী ছিল ৪ হাজার ১৯৩ জন বা ৮৩ শতাংশ। বাকি ৮৩২ জন বা ১৭ শতাংশ ছিল প্রসবপূর্ব বা প্রসব–পরবর্তী চিকিৎসা নিতে আসা নারী। প্রসবের আগে বা পরে নারীরা নানা ধরনের মানসিক চাপে থাকেন, সমস্যায় ভাগে। এসব নারীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সেই অর্থে দেশে নেই বললেই চলে।
বিস্তার কীভাবে হবে
গত এক-দেড় বছরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একাধিক সেমিনারে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এই মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ইতিহাস, বিকাশ ও সফলতা তুলে ধরেছেন। উদ্ভাবন হিসেবে এটি প্রশংসা পেয়েছে, বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ, গবেষক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এর প্রশংসা শোনা গেছে। কথা হচ্ছে, উদ্যোগটি চলছে মাত্র ছয়টি স্থানে, চলছে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে।
প্রকল্প শেষ হলে কী হবে, সারা দেশে এই বিস্তার কী সম্ভব? স্বাস্থ্য বিভাগ বা অন্য কেউ কী করছে বা ভাবছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগের বিস্তারে যুক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইসিডিডিআরবি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও ১৪টি মন–স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছে। যশোরে ছয়টি, চাপাইনবাবগঞ্জে চারটি ও বান্দরবানে চারটি কেন্দ্র। এগুলো এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রমক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই উদ্যোগটি খুবই কার্যকর। মানুষ সেবা পাচ্ছে। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জায়গার সংকট আছে। সেটি বিবেচনায় রেখেই আমরা এই উদ্যোগের বিস্তারের কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছি।’
রোবেদ আমিন আরও জানান, পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পৃথক ও নতুন একটি কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনার প্ল্যান) তৈরি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। সেই কর্মপরাকল্পনার মাধ্যমে দেশব্যাপী ধীরে ধীরে মন–স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিস্তার ঘটানো হবে।