হাঙ্গেরিতে চাকরি হারিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, তাঁর হাতে এল চিকিৎসার নোবেল
করোনার এমআরএনএ টিকা আবিষ্কারে ভূমিকার জন্য এ বছর যে দুজন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের একজন ক্যাটালিনা কারিকো। হাঙ্গেরিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও কয়েক দশক তিনি কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। লেগে ছিলেন এমআরএনএ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণায়। করোনা মহামারিকালে তাঁর ওই গবেষণা মানবজাতিকে নতুন দিশা দিয়েছে, মর্ডানার করোনার টিকা তৈরি করা হয় এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। ক্যারিকোকে নিয়ে ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল ‘যাঁর হাত দিয়ে এসেছে মডার্নার টিকা’ শিরোনামে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। আজ তাঁর নোবেল প্রাপ্তির ঘোষণায় লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
ইউনিভার্সিটি অব জাগেড হাঙ্গেরির নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। সবে সেখান থেকে পিএইচডি শেষ করেছেন ক্যাটালিন কারিকো। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার একটি চাকরিও জুটে গেল। ১৯৮৫ সাল। হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট সরকার বাজার অর্থনীতির রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। দেশজুড়ে আর্থিক সংকট। হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় গবেষণা বরাদ্দ। চাকরি হারান ক্যাটালিন। হাঙ্গেরির ছোট এক শহরে জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন মাংস বিক্রেতা। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে কোনো দিন কোনো বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসেননি, এমনকি চোখেও দেখেননি।
মেধার জোরে সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। হঠাৎ বরাদ্দ বন্ধ হওয়ায় দমে গেলেন না ক্যাটালিন। চাকরি খুঁজতে থাকলেন। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ পেয়েও গেলেন। দুই বছরের মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্র। পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ—গবেষণার কাজ। স্থায়ী নয়, দুই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি কাজ। হাঙ্গেরি থেকে বিদেশ যাওয়ার সময় নাগরিকেরা সঙ্গে মাত্র ১০০ ডলার নিয়ে যেতে পারতেন। স্বামী আর ছোট্ট মেয়ের খেলনায় লুকিয়ে বেশ কিছু ডলার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেন ক্যাটালিন।
স্বপ্নের দেশে কোনো কিছুই স্বপ্নের মতো ছিল না। পদে পদে বাধা। ক্যাটালিন কারিকোর বয়স এখন ৬৬। সহকর্মীদের কাছে কাটি নামেই পরিচিত। এই ক্যাটালিন আর তাঁর সহকর্মী ড. ড্রিউ ওয়াইজমানের গবেষণায় সম্ভব হয়েছে কোভিড-১৯ টিকা বানানো। দুজন দীর্ঘদিন কাজ করেছেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমআরএনএ বা মেসেঞ্জার আরএনএ ব্যবহার করে মানবকোষকে ওষুধ ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেলার ধারণাকে একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য ক্যাটালিন আর ওয়াইজম্যানের অবদান অনেক।
ক্যাটালিনকে ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় এক গবেষণাগার থেকে আরেক গবেষণাগারে সাময়িক চাকরি করতে হয়েছে। কখনোই স্থায়ী চাকরি পাননি। পাননি অধ্যাপনার কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত গবেষকেরা সরকারি বা দাতব্য সংস্থা থেকে তিন বা পাঁচ বছর মেয়াদের গবেষণা বরাদ্দ আনেন। এই টাকায় অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হতো গবেষকদের। এখান থেকেই মেটানো হতো গবেষণার খরচ। শিক্ষাকালের অধিকাংশ সময়ই নিজের প্রকল্পে বিশেষ কোনো বড় বরাদ্দ পাননি ক্যাটালিন। তাঁর ধারণাকে কল্পবিজ্ঞান বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বরাদ্দদাতারা। ক্যাটালিন এ সবে দমেননি। নিজের মেধা আর মননে পিছিয়ে থাকা বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে এক কোণে নামমাত্র বেতনে এমআরএনএ নিয়ে গবেষণা করে গেছেন।
আমেরিকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন এমআরএনএ নিয়ে একেবারে পাগলের মতো লেগে ছিলেন ক্যাটালিন। ১৯৮৯ সাল এমআরএনএ নিয়ে বড় বড় গবেষণা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। গবেষণার একটা বরাদ্দ পেলেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এলিয়ট বারনামন। সেখানেই বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিলেন ক্যাটালিন। অস্থায়ী। উদ্দেশ্য এমআরএনএকে কোষের ভেতরে ঢোকানো। তারপর কোষকে প্রোটিন বানানোর নির্দেশনা দেওয়া। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যাবতীয় কাজের জন্য প্রোটিনের ভূমিকা অপরিহার্য। প্রোটিন বানালেই তো হবে না। নতুন প্রোটিন তৈরি হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে হবে।
১৯৮৯ সালে এলিয়ট আর ক্যাটালিনের গবেষণার এই ধারণা শুনে অনেকেই হাসাহাসি করতেন। বেশ কিছুদিন পরে সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। এমআরএনএ ব্যবহার করে শরীরের কোষকে দিয়েই প্রোটিন তৈরি করেছিলেন তাঁরা। আর এই পদ্ধতিতেই শরীরে সংকেত পাঠিয়ে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণে কোভিডের অ্যান্টিজেন তৈরি হয়। কার্যকরী হয় আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শরীর মনে রাখে এই ভাইরাসের ধরন। উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করা।
এই আবিষ্কারের পরপরই পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন এলিয়ট। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ক্যাটালিনার চাকরি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয় নিজের গবেষণার জন্য বরাদ্দ নিয়ে এলে বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি থাকবে। আসলে এ বিষয়ে গবেষণায় বরাদ্দ পাওয়া তখন একরকম অসম্ভব ছিল। এ সময় এগিয়ে এলেন ড. ল্যাংগার। নিউরোসার্জন। বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করলেন ক্যাটালিনকে একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। ড. ল্যাংগারের এই অবদান ক্যাটালিন এখনো ভোলেননি।
ড. ল্যাংগার চাকরি বদল করে অন্য জায়গায় চলে যান। আবারও অনিশ্চিত হয়ে যায় ক্যাটালিনার গবেষণা। এ রকম সময় একদিন ফটোকপি করতে গেছেন ক্যাটালিন। সেখানেই ড্রিউ ওয়াইজম্যানের সঙ্গে আলাপ। ড্রিউকে বললেন এমআরএনএ দিয়ে যেকোনো প্রোটিন বানাতে পারি। শুনে চমকে গেলেন ড্রিউ, ‘ঠিক আছে করে দেখাও, চাকরি দেব।’ তবে শর্ত ছিল জীবিত প্রাণীর শরীরে করতে হবে। ল্যাবে বিকারের মধ্যে করলে হবে না। অনেক চেষ্টার পর ইঁদুরের শরীরে সফলভাবে এমআরএনএর মাধ্যমে প্রোটিন তৈরিতে সফল হলেন তাঁরা। একের পর এক গবেষণা বরাদ্দের আবেদন করতে থাকলেন দুজন। কোনো সাড়া নেই। নামকরা গবেষণা সাময়িকীতে প্রবন্ধ পাঠালেন। ফলাফল একই।
অবশেষে ইমিউনিটি নামের সাময়িকীতে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলো। কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তেমন কোনো সাড়া মিলল না। দুজনে এরপর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আর ওষুধ কোম্পানির কাছে এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা তুলে ধরে বিনিয়োগের অনুরোধ করলেন। ফলাফল একই—উৎসাহ নেই। অবশেষে আমেরিকার মডার্না আর জার্মানির বায়োএনটেকের নজরে আসেন এই দুই বিজ্ঞানী। বাকিটা সবার জানা। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অত্যন্ত সফল ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে এই দুই প্রতিষ্ঠান।
একাডেমিক ক্যারিয়ারে বছরে ৬০ হাজার ডলারের বেতনের চাকরি করেছেন। অস্থায়ী। কিন্তু তাতে কি? লক্ষ্যে অবিচল ক্যাটালিন আর ড্রিউ ওয়াইজম্যানের আবিষ্কারের কারণে শুরু হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন যুগ। ক্যাটালিন এখন বায়োএনটেকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আর ড্রিউ ওয়াইজম্যান পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক। হাঙ্গেরির প্রত্যন্ত এক শহরের মাংস বিক্রেতার মেয়ের বিজ্ঞান সাধনার কারণে ভবিষ্যতে এক নয়, একাধিক রোগের ভ্যাকসিন হাতের নাগালে আসবে। সম্ভব হবে ক্যানসারকেও বশে আনা।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]