বিদায় ২০২০
মুসলিম বিশ্বে বিভক্তিই কি ট্রাম্পের সাফল্য
আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক জোরদারে মূল ভূমিকা পালন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পর সুদান ও মরক্কো একই পথে হেঁটেছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আরও কয়েকটি মুসলিম দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা চলছে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আছেন আর মাত্র ২০ দিন। দেশটির বেশির ভাগ প্রেসিডেন্ট পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতার স্বাদ পান। কিন্তু ট্রাম্পের কপালে সেটা জুটল না। বিশ্বজুড়ে চার বছর রাজত্ব করে তিনি বিদায় নিচ্ছেন আগামী ২০ জানুয়ারি।
ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের অর্জন–ব্যর্থতার হিসাব নিশ্চয় হবে। সারা জীবন রাজনীতি না করেও সরাসরি হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন তিনি। আর এরপর চারটি বছর ধরে নানা ঘটন–অঘটনে ছিলেন মূলত সমালোচনার মুখেও। তারপরও কিছু ভালো কাজ তিনি করেছেন। তাঁর সমর্থকেরা অন্তত সেগুলো সামনে আনতে চাইবেন। সেই তালিকায় সম্ভবত সামনে থাকবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।
যদিও মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করে ট্রাম্পের এই প্রাপ্তিকে তাঁর সাফল্য বলবেন নাকি উল্টো সমালোচনা করবেন, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতা ও উদ্যোগে গত চার মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে চার আরব দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানের পর সর্বশেষ ঘোষণা দিয়েছে মরক্কো। মিসর ও জর্ডানও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়, এমন নীতিতেই দীর্ঘদিন চলছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু সেই নীতি থেকে অনেকটা হঠাৎ সরে এসেছে তারা।
এ কাজে দূতিয়ালির কাজ করেছেন ট্রাম্পের জামাতা ও তাঁরই উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পারিবারিক বন্ধু তিনি।
ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ১০ ডিসেম্বর। ট্রাম্প এ নিয়ে তাঁর টুইটে বলেন, ‘আজ আরেকটি বিশাল সাফল্য অর্জিত হলো। আমাদের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েল ও মরক্কো পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক বড় একটি অর্জন।’
মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের সঙ্গে ওই দিন টেলিফোনে কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। এরপরই আসে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাটি। বিনিময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরোধপূর্ণ পশ্চিম সাহারার ওপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়েছেন। মরক্কোর জন্য এটি এক বিরাট অর্জন। এ প্রসঙ্গে জ্যারেড কুশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসরায়েলে দূতাবাস খুলতে রাবাত ও তেল আবিবে শিগগিরই লিয়াজোঁ অফিস আবার চালু করছে মরক্কো। সৌদি আরবও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে। এটা অনিবার্য।’
ট্রাম্প প্রশাসনের একপেশে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার অন্যতম কুশীলব এই কুশনার। যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির একজন বড় সমর্থকও তিনি। ট্রাম্পের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়েও আছে নানা সমালোচনা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে বা করতে রাজি হয়েছে, এর সব কটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। সম্পর্কের বিনিময়ে সুদানকে সন্ত্রাসবাদের কালো তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রথম ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ বিষয়ে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল এ তিন দেশ।
এভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে একের পর আরব দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে ট্রাম্প যতই কৃতিত্ব জাহির করুন না কেন, বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বহু দূরেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বৃহত্তর এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবে, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এখন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আরব দেশের অতীতে যুদ্ধ হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই এসব চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশ বিরোধিতা করে এগুলোকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছে।
ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া, আরব দেশগুলো যা করেছে, তা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ইসরায়েলের সঙ্গে আমিরাতের চুক্তি সইয়ের পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আমিরাত থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে ইরান ও তুরস্কও।
মুসলিম দেশগুলোর এই বিভক্ত অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। দিজ উইক ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এই চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করবে, লড়াইয়ের মুখোমুখি করে তুলবে ও ইসরায়েলের আগুনে তেল ঢালবে।’ এই চুক্তি ইসরায়েলের অবস্থান আরও শক্তিশালী ও ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অধীন করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হওয়াই যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
এদিকে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া, আরব দেশগুলো যা করেছে, তা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ইসরায়েলের সঙ্গে আমিরাতের চুক্তি সইয়ের পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আমিরাত থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে ইরান ও তুরস্কও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশশাসিত ফিলিস্তিনে গজিয়ে ওঠে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। পশ্চিমা বিশ্বের বানানো এ রাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেয়নি আরবরা। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও সবশেষ ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ হয় পশ্চিমা মদদপুষ্ট রাষ্ট্রটির। এরপর থেকে ইহুদিদের কাছে জমি হারাতে থাকে ফিলিস্তিনিরা। বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ–সমালোচনার মুখে পশ্চিমাঘেঁষা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর চেষ্টা করে। অবশ্য তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।
আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলো প্রধান তিনটি শর্ত দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গঠন ও স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে দখল করা জমির হস্তান্তর—এ তিন শর্তের কোনোটাও পূরণ হয়নি। তারপরও রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে আরব দেশগুলো। এর পেছনে ট্রাম্পের ঈর্ষণীয় ‘সাফল্যের’ করুণ পরিণতিটা কী, সেটি দেখতে ফিলিস্তিনিদের হয়তো আর বেশি অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে না।
{তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স ও আল–জাজিরা}