করোনার টিকার হালহকিকত
করোনাভাইরাসের (কোভিড ১৯) সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশেই চলছে টিকাদানের তোড়জোড়। কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে তৈরি করেছে টিকা। অনেক দেশ এখনো করছে। সর্বশেষ নতুন আসা দুটি টিকার শেষ ধাপের পরীক্ষায় বড় ধরনের কার্যকারিতা দেখা গেছে। বিবিসি অনলাইন এক প্রতিবেদনে টিকার হালহকিকত তুলে ধরেছে।
আমাদের টিকা কেন প্রয়োজন?
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠী এই ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই ভাইরাস থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো নিজেকে বিধিনিষেধের আওতায় রাখা। এতে করে ভাইরাসের সংক্রমণ সীমিত হয়। টিকা শরীরকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখায় এবং এর রেহাই পাওয়ার কৌশল হিসেবে কাজ করে।
টিকা তৈরিতে বড় তিন প্রতিষ্ঠান
টিকা তৈরিতে এগিয়ে থাকা তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর মধ্যে ফাইজার ও মডার্না আরএনএ প্রযুক্তির টিকা তৈরি করেছে, যা পদ্ধতি হিসেবে নতুন। এতে দ্রুত টিকা তৈরি করা সম্ভব। এতে ভাইরাসের জেনেটিক কোডের ক্ষুদ্র একটি অংশ দেহে প্রবেশ করানো হয়। এতে করোনাভাইরাসের একটি অংশ তৈরি করতে শুরু করে এবং শরীর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ প্রযুক্তির টিকা যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পেয়েছে। অন্যদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাটি আলাদা। এতে নিরীহ ভাইরাস ব্যবহার করে শরীরে জেনেটিক উপাদান প্রবেশ করানো হয়। এ টিকাটি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে অনুমোদন পেয়েছে।
অক্সফোর্ডের টিকাটি অন্য দুটি টিকার চেয়ে প্রয়োগ ও সংরক্ষণ করা সহজ। সব কটি টিকার দুটি ডোজ করে দিতে হয়। তবে যুক্তরাজ্য যতটা সম্ভব বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং দ্বিতীয় ডোজ দিতে দেরি করছে।
নতুন আরও ২ টিকা
নতুন আরও দুটি টিকা বাজারে আসার পথে। একটি নোভাভ্যাক্স আর অপরটি হলো জেনসেন। যুক্তরাজ্যে বৃহৎ পরিসরে নোভাভ্যাক্সের টিকার পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নোভাভ্যাক্সের টিকা ৮৯ দশমিক ৩ শতাংশ কার্যকর। নোভাভ্যাক্সের পক্ষ থেকে এই তথ্য জানানো হয়।
আর জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি টিকা মাঝারি ও গুরুতর পর্যায়ের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ৬৬ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করেছে। বিশ্বব্যাপী তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে জনসন জানিয়েছে, শুধু গুরুতর পর্যায়ের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে টিকাটি ৮৫ শতাংশ কার্যকর। এই টিকা তৈরিতেও অক্সফোর্ডের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে জনসনের টিকা এক ডোজের।
বিশ্বের বাকিরা কী করছে
ইউরোপীয় দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিভিন্ন দেশে উল্লেখ করার মতো টিকা তৈরি হয়েছে। চীনা গবেষকেরা তৈরি করেছেন সিনোভ্যাক, ক্যানসিনো ও সিনোফার্ম নামের টিকা। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশের সঙ্গে তাদের চুক্তিও হয়েছে। এই মধ্যে চীনের ১০ লাখ মানুষকে সিনোফার্ম টিকা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আজ মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রাশিয়ার তৈরি টিকা স্পুতনিক-ভি ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে। করোনার উপসর্গ থাকা ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এই কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ। এই টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এমন দাবি করা হয়। এর আগে টিকাটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছিল এটা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশে করোনা ঠেকাতে স্পুতনিক-ভি মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
কতটি টিকার পরীক্ষা হয়েছে
প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে ১৭১টি টিকা। টিকার নিরাপত্তা নিয়ে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ১৯টি, বিস্তৃত পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ২৫টি এবং ব্যাপক আকারে পরীক্ষার পর কার্যকারিতা মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে ২১টি টিকা। ব্যাপক আকারে পরীক্ষার পর টিকার মধ্যে এরই মধ্যে কয়েকটিকে বিভিন্ন দেশ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটির অনুমোদন দিয়েছে।
সব টিকা কি সমান কার্যকর?
এক কোম্পানির টিকার পরীক্ষার ফলের সঙ্গে অন্য কোম্পানির টিকার তুলনা করা কঠিন। কারণ, এসবের পরীক্ষা পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের টিকাগুলো বড় ধরনের কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এর ফলে কোভিডে-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার মতো অবস্থা বা মৃত্যু হতে পারে ওই পর্যায়ে আর রোগীদের যেতে হবে না। তবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন একটাই। এই টিকা কি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম? যার উত্তর এখনো অজানা।
করোনার নতুন ধরন নিয়ে চিন্তা
করোনার নতুন ধরনগুলো বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ধরনের বিরুদ্ধে জনসন ও নোভাভ্যাক্সের ব্যাপক কার্যকারিতা দেখা গেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, অন্য যেকোনো টিকার তুলনায় এ দুটি বেশ ফলপ্রসূ। তবে ভবিষ্যতে টিকার আরও পরিবর্তন আনতে হতে পারে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
প্রথম টিকা পাবে কে?
প্রতিটি দেশই প্রথম দিকে কাদের টিকা দেওয়া হবে, সেই অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করছে। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সম্মুখ সারীর কর্মীরা, কেয়ার হোমের বাসিন্দা ও কর্মীরা এবং ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। দেশটির পরিকল্পনা হলো, বয়োজ্যেষ্ঠ ও যাঁরা স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাঁদের টিকা দেওয়া।