মধ্যযুগের উন্নত ও বৃহৎ ১০ নগর

৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ও ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যবর্তী এক হাজার বছরকে মধ্যযুগ বলে বিবেচনা করা হয়। এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই বললেই চলে। ইউরোপের জন্য এ যুগ মূলত সম্পদ, বাণিজ্য এবং জনশূন্য শহর ও নগরের পতনের জন্য পরিচিত। তবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য এ যুগ ছিল একেবারেই ভিন্ন। এ সময় মধ্যপ্রাচ্য ইসলামি স্বর্ণযুগের ফল ভোগ করেছে। চীন আগের মতোই শক্তিশালী ছিল। আর ভারত ছিল একটি অর্থনৈতিক শক্তি। ওই সময় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শহরে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু শহর বিশাল আকার ধারণ করেছিল। মধ্যযুগের বৃহৎ ১০ নগর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ডটকম। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো—

কাইফেং, চীন

কাইফেং বহু শতাব্দী ধরে চীনের রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্র ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে শহরটি ওয়েই রাজ্যের রাজধানী হওয়ার পর প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। সং রাজবংশের শাসনামলে এটিকে আবারও রাজধানী করা হয়। কাইফেং ছিল আশ্চর্যজনকভাবে বৈচিত্র্যময় একটি শহর। এশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চল থেকে বেশি জাতিগত ও ধর্মীয় এলাকা ছিল এটি। এ শহরে চীনা ইহুদিদের একটি বিশাল সম্প্রদায় বাস করত। ধারণা করা হয়, তারা দ্বাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পারস্য বা ভারত থেকে প্রথম কাইফেংয়ে এসেছিল। এ শহর সং রাজবংশের একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। অর্থনীতির ভালো অবস্থার কারণে লাখ লাখ মানুষ এ শহরে বসবাস ও কাজ করতে আকৃষ্ট হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, দ্বাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে শহরটির জনসংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছিল।

অ্যাংকর, কম্বোডিয়া

কম্বোডিয়ার অ্যাংকর শহরের অবস্থিত বিখ্যাত মন্দির অ্যাংকর ওয়াট
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।

অ্যাংকর নামের পরিচিত শহরটি প্রায় ৬০০ বছর ধরে খেমার সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল। বর্তমানে এটি অ্যাংকর ওয়াট মন্দিরের জন্য বিশ্বখ্যাত। বিশাল এই মন্দির ১২ শতকে রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের শাসনামলে নির্মিত হয়। ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যপথ এবং ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রুট নিয়ন্ত্রণ করে খেমার সাম্রাজ্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। শহরটিতে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের বসবাস ছিল বলে ধারণা করা হয়। অ্যাংকর শহরটি এক রহস্যময় পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিল। ১৬ শতকের মধ্যে শহরটি বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সসহ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। অ্যাংকর শহরের কী হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরিভাবে জানা যায়নি। তবে নেতৃস্থানীয় তত্ত্বগুলো থেকে জানা যায়, শহরটি কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছিল। ফলে শহরের বিশাল জনপদ নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম, ভারত

ভারতের গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম শহরের একটি মন্দির
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।

গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম ছিল শক্তিশালী চোল রাজবংশের রাজধানী। এই রাজবংশ দশম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার বড় একটি অংশ শাসন করেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী পাল রাজবংশের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের পর চোল শাসক প্রথম রাজেন্দ্রের নির্দেশে এ শহর নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন শহরটি সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ ও বিভিন্ন মন্দির কমপ্লেক্সের জন্য বিখ্যাত। চোল শাসকেরা শিল্পকর্ম তৈরির জন্য সুপরিচিত ছিলেন। গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরমের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ প্রায় তিন লাখে পৌঁছেছিল। ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে চোল রাজবংশের পতনের পর শহরটি পতনের মুখে পড়েছিল।

কিয়োটো, জাপান

জাপানের কিয়োটো শহর
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাপানের রাজধানী কিয়োটো শহর। ৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কিয়োটো জাপানের বিভিন্ন রাজনৈতিক শাসকের আসন হিসেবে কাজ করে আসছে। সম্রাট ও শোগুন উভয়ই কিয়োটো থেকে জাপান নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে এ শহরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতেন। ভূখণ্ডের একেবারে ভেতরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও কিয়োটো জাপানের অন্যান্য উপকূলীয় শহরের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদশালী হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। বৃহৎ কেন্দ্রীয় সরকার জাপানি অভিজাতদের জন্য বাজার, সরাইখানা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করতে গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর লোককে এ শহরে নিয়ে এসেছিল। মধ্যযুগে বেশির ভাগ সময় ধরে শহরটি সমৃদ্ধি লাভ করে। তবে ১৫০০ সালে জাপানে নৃশংস গৃহযুদ্ধের সময় শহরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এটি ধীরে ধীরে তার অবস্থান ফিরে পায়। কিন্তু ১৯ শতকে কিয়োটোকে ছাড়িয়ে সমৃদ্ধিশালী শহর হয়ে ওঠে এডো, অর্থাৎ বর্তমান টোকিও।

কায়রো, মিসর

মিসরের রাজধানী কায়রো
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।

আধুনিক মিসরের রাজধানী কায়রো ছিল মধ্যযুগের অন্যতম ধনী ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বিজয়ের সময় একটি সামরিক ঘাঁটি হিসেবে শহরটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ শহর আইয়ুবী রাজবংশের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল, যা কিংবদন্তি সেনাপতি সালাহউদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সালাহউদ্দিন ১২০০ শতাব্দীতে সংঘটিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রুসেডের সময় একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। শহরটির অবস্থান নীল নদের তীরে হওয়ায় বাণিজ্য করার জন্য এখান থেকে খুব সহজে ভূমধ্যসাগর এবং অসংখ্য রাজ্য ও সাম্রাজ্যে প্রবেশ করা যেত। ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শহরটি সম্প্রসারিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম শহরে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি।

তাঞ্জাভুর, ভারত

ভারতের তাজ্ঞাভুর শহরের বৃহদীশ্বর মন্দির
ছবি: এক্স থেকে

তাঞ্জাভুর ছিল চোল রাজবংশের প্রথম রাজধানী। গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরমের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত এ শহর। এটির সঙ্গে তাঞ্জাভুরের অনেক মিল পাওয়া যায়। তাঞ্জাভুরের বিস্তার অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, এটি কোনো মহান সামরিক বিজয়ের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাঞ্জাভুর শহরটি গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরমের মতো ধর্মীয় ভবনের প্রাচুর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানেও ছিল বিভিন্ন মন্দির আবাসস্থল। তাঞ্জাভুরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাস ছিল। চোল সম্রাজ্যের নতুন রাজধানী হিসেবে গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরমের উত্থানের পর তাজ্ঞাভুরের পতন শুরু হয়। তবে চোল সাম্রাজ্যের পতনের পরও এ শহরের প্রাসঙ্গিকতা ছিল। বিজয়নগর, মারাঠা, এমনকি ব্রিটিশরাও তাঞ্জাভুরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিল।

কনস্টান্টিনোপল, তুরস্ক

কনস্টান্টিনোপল, অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্থাপনা আয়া সোফিয়া
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

কনস্টান্টিনোপল মধ্যযুগে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের (পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য) রাজধানী ছিল। বর্তমানে এ শহরের নাম ইস্তাম্বুল। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পতনের পর থেকে কনস্টান্টিনোপল রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার এবং মহিমা বহন করে চলেছিল। প্রায় নিখুঁত ভৌগোলিক অবস্থানে শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহরটি কেবল ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ছিল। ফলে এটি দখল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অটোমানরা ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। ঐতিহাসিকেরা বেশির ভাগই একমত, ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় শহরটির পতন হয়। রোমানরা শহরটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেও এটি আর কখনো তার পূর্বের গৌরব ফিরে পায়নি।

বাগদাদ, ইরাক

হাজার বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের মাথার মুকুট ছিল বাগদাদ। ইসলামি স্বর্ণযুগে অনেক সাফল্য ও অর্জন বাগদাদের গ্রন্থাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্পন্ন হয়েছিল। বাগদাদের অবস্থান এটিকে রাজধানীর জন্য একটি আদর্শ স্থান করে তুলেছিল। বিভিন্ন মুসলিম খলিফা তাঁদের বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য বাগদাদকে রাজনৈতিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ইউরোপ থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিক রুট সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ স্টপ হিসেবেও এ শহর কাজ করেছিল। নির্দিষ্ট কিছু শাসকের অধীন বাগদাদের পতন শুরু হয়েছিল। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগলরা শহরটি ধ্বংস করে। শহরটিকে এত ভয়াবহভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল যে শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এটির পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

নিশাপুর, ইরান

তৃতীয় শতাব্দীতে সাসানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে নিশাপুর শহরের গোড়াপত্তন হয়। সপ্তম শতাব্দী থেকে ইসলামি শাসনামলে শহরটি এ অঞ্চলের একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে সমৃদ্ধি লাভ করে। উচ্চমানের রেশম, তুলা ও অন্যান্য বস্ত্র উৎপাদনের জন্য নিশাপুর বিখ্যাত ছিল।
নিশাপুরের পরিণতি হয়েছিল বাগদাদের মতোই। মোগলরা শহরটি লুণ্ঠন করে নিয়েছিল। এ ছাড়া একের পর এক ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল শহরটি। পরিণতিতে একসময়ের ব্যস্ত শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বেশির ভাগ বাসিন্দা পালিয়ে যায় কিংবা নিহত হয়।

১০

কর্ডোবা, স্পেন

মধ্যযুগে আধুনিক স্পেনের বেশির ভাগ অংশ শাসন করা বিভিন্ন ইসলামি খিলাফতের হৃৎস্পন্দন ছিল কর্ডোবা। অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিমদের হামলার সময় মূল শহরটি মূলত ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কর্ডোবা ইউরোপের বৃহত্তম শহর এবং সম্ভবত কনস্টান্টিনোপলের পাশের সবচেয়ে বড় মহানগর ছিল। উমাইয়া শাসনামলে শহরটিতে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। ১২৩৬ সালে খ্রিষ্টান বাহিনী শহরটি পুনর্দখল করে। তখন শহরটি মুসলিম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চলমান সামরিক অভিযানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।