সিআইএর ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন মজিদ
৪১ বছর বয়সী মজিদ খান আল-কায়েদার সাবেক সদস্য। গুয়ান্তানামো বে সামরিক কারাগারের এই বন্দী মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ংকর কৌশল প্রথম প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁর ওপর চলা সিআইএর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আদালতে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার সামরিক আদালতে উপস্থিত ছিলেন মজিদ। সাবেক এই আল-কায়েদা সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধাপরাধ, হত্যা ও বোমা হামলায় সংশ্লিষ্টতার মতো অভিযোগগুলো স্বীকার করেছেন। শুনানি শেষে আজ শুক্রবার রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে আদালতের। রায়ে তাঁর ২৫ থেকে ৪০ বছরের সাজা হতে পারে।
গতকাল শুনানির সময় মজিদ বলেন, পাকিস্তান থেকে ২০০৩ সালে আটক হন তিনি। এরপর তাঁকে হস্তান্তর করা হয় সিআইএর হাতে। তিনি সিআইএকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। আশা ছিল একটাই—মুক্তি মিলবে। মজিদের ভাষ্য, যতই তিনি সহায়তা করেছেন, ততই বেড়েছে নির্যাতনের মাত্রা।
যেভাবে জড়ালেন আল-কায়েদায়
মজিদ খানের জন্ম সৌদি আরবে। আট ভাই–বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। মজিদের শৈশব কেটেছে পাকিস্তানে। তাঁর বয়স যখন ১৬, তখন তাঁর বাবা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের একটি গ্যাস স্টেশনের মালিকানা পান। ফলে সপরিবারে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মজিদ পড়াশোনা করেছেন দেশটির একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। পরে চাকরিজীবন শুরু করেন একটি মার্কিন টেলিযোগাযোগসংক্রান্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার সময় ওই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের টেলিফোন ব্যবস্থা দেখভালের সঙ্গে জড়িত ছিল।
মার্কিন সামরিক আদালতকে মাজিদ বলেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার কয়েক মাস আগে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর জীবনধারা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ২০০২ সালে একটি পারিবারিক ভ্রমণে পাকিস্তানে ফিরে আসেন মজিদ। সেখানেই তাঁর বিয়ে হয়। দেখা হয় অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আগে থেকে যোগ দিয়েছিলেন আফগান যুদ্ধে। যোগাযোগ ছিল আল-কায়েদার সঙ্গেও। তাঁরা মজিদকে সংগঠনটিতে যোগ দিতে চাপ দেন।
মজিদ বলেন, ‘আমি পথ হারিয়েছিলাম এবং আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। তাঁরা (পরিবারের সদস্য) আমার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছিল।’ এমনকি গুয়ান্তানামো বে সামরিক কারাগারের নানা ‘ভুয়া ভিডিও’ দেখানো হয়েছিল।
মজিদের ভাষ্য, ‘আমি নিজ ইচ্ছায় আল-কায়েদায় যোগ দিয়েছিলাম। আমি বোকা ছিলাম, অনেক বোকা। তারা আমার কষ্টগুলো থেকে মুক্তি দেওয়ার এবং পাপ থেকে শুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর আমি তাদের বিশ্বাস করেছিলাম।’
সিআইএর কাছে যা স্বীকার করেন মজিদ
মজিদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে আল-কায়েদার একটি শাখার কাছে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার সরবরাহের কাজেও জড়িত ছিলেন মজিদ। ওই অর্থ ২০০৩ সালের আগস্টে ম্যারিওট হোটেলে বোমা হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব অভিযোগের সবই স্বীকার করেছেন মজিদ। তবে সিআইএর হাতে বন্দী থাকার সময় তিনি জানিয়েছিলেন, কী কাজে ওই অর্থ ব্যবহার করা হবে, তা তিনি জানতেন না।
২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে হত্যা পরিকল্পনাতেও জড়িত থাকার কথাও সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন মজিদ। তবে ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পারভেজ মোশাররফকে হত্যার এই পরিকল্পনায় তিনি কাজ করেছিলেন খালিদ শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে। ৯/১১ হামলার ‘হোতা’ হিসেবে মনে করা হয় এই ব্যক্তিকে। খালিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরও নানা অপরাধের পরিকল্পনা করার বিষয়েও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন মজিদ।
বিবস্ত্র করে চলত মারধর
সিআইএর বন্দিশিবিরে থাকার সময় নির্যাতনে বর্ণনা আদালতে শুনিয়েছেন মজিদ খান। তিনি বলেন, ওই দিনগুলোতে তাঁকে বিবস্ত্র করে মারধর করা হতো। ‘কুকুরের মতো’ দীর্ঘ সময় বেঁধে রাখা হতো শিকল দিয়ে। ছাদের সঙ্গে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। শ্বাসরোধ করতে নাকে-মুখে ঢেলে দেওয়া হতো পানি। এমনকি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে নেওয়ার সময় তাঁর মাথায় দেয়াল, সিঁড়ি ও মেঝের আঘাত লাগত। তবে কিছুই করার ছিল না তাঁর।
লম্ব সময় ধরে ঘুমাতেও দেওয়া হতো না মজিদকে। একপর্যায়ে তিনি জেগে থাকা অবস্থায় অস্বাভাবিক ঘটনা দেখা শুরু করেন। মজিদের ভাষ্য, বন্দিশিবিরের কক্ষের ভেতরে তাঁকে একদিন হাতে শিকল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এ সময় তিনি দেখতে পান একটি গরু ও একটি টিকটিকি তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে। সেগুলো সত্যি ভেবে পা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে উল্টো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্যথা পান তিনি।
২০১৪ সালে সিআইএর কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি। ওই প্রতিবেদনে মজিদ খানের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরা হয়। ওই কমিটি সে সময় জানায়, মজিদ খাবার খেতে না চাইলে সিআইএ সদস্যরা তাঁর পায়ুপথ দিয়ে খাবার ঢুকিয়ে দিতেন। নাক দিয়ে নল ঢুকিয়েও খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হতো।
গোয়েন্দা সংস্থাটির নির্যাতনের এই পদ্ধতিকে ধর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন মজিদ। কোনো বন্দী পানি পান করতে না চাইলে তাঁর সঙ্গেও একই আচরণ করা হতো বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। মজিদ বলেন, তাঁকে সিআইএর বন্দিশিবিরে প্রার্থনা করারও সুযোগ দেওয়া হতো না।
কী বলছে সিআইএ
মজিদের নির্যাতনের বর্ণনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি সিআইএ। তবে তারা জানিয়েছে, আটক ও জিজ্ঞাসাবাদসংক্রান্ত এ ধরনের কর্মকাণ্ড ২০০৯ সালেই শেষ হয়েছে।
সিআইএ যা–ই বলুক না কেন নির্যাতনকারীদের উদ্দেশে মজিদ আদালতে বলেন, ‘যাঁরা আমাকে নির্যাতন করেছেন, তাঁদের আমি ক্ষমা করলাম। আর নিজের করা অন্যায়ের জন্যও ক্ষমা চান মজিদ।