‘ডোন্ট ক্রাই বয়েজ’। আমেরিকায় বিলবোর্ড-টিভিতে বহুবার পড়েছি। পুরুষ কাঁদে না। কাঁদে নারী। কখনো নীরবে, কখনো হাউমাউ করে। তাদের অনুভূতি তীব্র। অল্পতেই অশ্রু ঝরে। তাই বলে পুরুষ কাঁদে না!
একসময় চেষ্টা করেও কাঁদতে পারিনি। ষাটের দশকের শুরুতে, আমি তখন ক্লাস সেভেনে। সিলেটের শহরতলি মোগলাবাজারে, বাড়িতে থাকি। বাবা থাকেন শহরে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহকুমা পুলিশ অফিসার।
দুপুরে বাড়ির পুকুরের পাড়ে খেলছিলাম। এ সময় আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন সাহেব আরও দু-একজন আমার কাছে এসে পরম সোহাগে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন। আমি নির্বাক। বোবার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর দৌড়ে পাশের এক ছোট ঘরে ঢুকে আপ্রাণ চেষ্টা করলাম কাঁদতে। পারিনি। চেয়ারম্যান সাহেব ডাকলেন, তোমাকে শহরে নিয়ে যাব। এসো। আমি তখন নিথর-পাথর।
সেদিন বাবার জন্য কাঁদতে না পারলেও পরবর্তী জীবনে ঘটে এর উল্টো। উপলব্ধি করি, আমার জীবনের পুরোটাজুড়ে আছেন আমার বাবা। এখনো ষাটোর্ধ্ব বয়সেও দুঃখ-বিষণ্নতার মুহূর্তে বাবার কথা মনে হলে আপসে চোখে জল আসে। ঠেকাতে পারি না। দুগাল বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু।
বাবা ছাড়া আরও একজনের জন্য এমনটি ঘটেছিল। মন-প্রাণ উজাড় করে কেঁদেছিলাম। সে কথা আজ বলব।
স্কুলজীবনে সবার মুখে শেখ মুজিবের নাম শুনতাম। কখনো দেখিনি তাঁকে। শুধু ছবি। বাংলার মুক্তির জন্য তিনি আন্দোলন–সংগ্রাম করতেন। আপসহীন সাহসী নেতা। জেল-জুলুমের তোয়াক্কা না করে সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে মুক্তির কথা বলতেন। মানুষকে জাগাতেন। সরকার বারবার বন্দী করে জেলে পাঠাত। জীবনের এক বড় সময় কেটেছে জেলে ।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি। এক দুপুরে মাকে নিয়ে মোগলাবাজারে যাওয়ার জন্য সিলেট রেলস্টেশনে এসেছি। রিকশা থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুহূর্তে দেখলাম, একটি জিপ এসে থামল গেটের কাছে। পেছনে পুলিশের ভ্যান। চিনতে ভুল হয়নি। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। চোখে ঘন চশমা। ঠোঁটে পাইপ। লম্বা সুপুরুষ, তেজোদীপ্ত। শেখ মুজিবুর রহমান। ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ট্রেনটি ছিল লোকাল। ঢাকায় যায় শুধু সুরমা মেইল। সন্ধ্যায় ছাড়ে। তাহলে কোথায় যাচ্ছেন শেখ মুজিব। নেতাকে দেখার জন্য ট্রেনের পাশে ভিড় বাড়ছে। জানলাম, বন্দী শেখ মুজিব সিলেটের আদালতে হাজিরার পর কাল হাজিরা দেবেন মৌলভীবাজারে। লোকাল ট্রেনে কুলাউড়া, সেখান থেকে সড়কপথে মৌলভীবাজার। জেলায় জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা। জেল থেকে জেলে, কোর্ট থেকে কোর্টে। তবু কি তাঁকে দমানো যায়?
প্রথম দেখায় মুজিব মনের গহিনে পরম মুগ্ধতায় স্থান পেলেন, যা আজও অম্লান। ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিব সারা দেশ সফর করছেন, জনমত গড়ে তুলছেন। ছয় দফার পক্ষে। সেদিন সুরমা মেইলে আসছেন সিলেটে। সকালে মোগলাবাজার রেলস্টেশনে প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কিছু নেতা–কর্মী জড়ো হয়েছেন। ট্রেন থামতেই তাঁদের দু-তিনজন উঠে পড়লেন শেখ মুজিবের কামরায়। আমি তাঁদের সঙ্গী হলাম। দুই আসনের ছোট কামরায় এক পাশে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব। হাতে পাইপ। এত কাছে তাঁকে দেখব ভাবিনি। শেখ মুজিব এক কর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজিজ, কেমন আছিস?’ আবদুল আজিজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি অবাক হলাম, এত বড় নেতা শেখ মুজিব ইউনিয়ন পর্যায়ের এক কর্মীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তিনি দু–একজন কর্মীর কুশলাদি জানতে চাইলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী ফরিদ আহমেদ, সাইস্তা মিয়া, আইয়ুব আলী, তফাজ্জল হোসেনের মধ্যে সেদিন কে কে ছিলেন, মনে করতে পারছি না।
শেখ মুজিবের সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল বিশাল। দলের তৃণমূলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে তিনি চিনতেন। তাঁর এ গুণের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হয় না। কর্মীরাই ছিলেন তাঁর বড় সম্পদ। সম্পর্ক ছিল গভীর আন্তরিক। এই আত্মিক সম্পর্ক শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে অফুরান শক্তি জুগিয়েছে।
মোগলাবাজার থেকে সিলেট। ট্রেনে ১০/১৫ মিনিটের পথ। এ সময়টুকু নির্বাক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁকে দেখলাম।
সিলেট রেলস্টেশন লোকে লোকারণ্য। ব্যান্ড বাজছে। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে সুসজ্জিত জনতার মুহুর্মুহু স্লোগান। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন জবাব চাই’, ‘ছয় দফা মানতে হবে’। দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নেতাকে বরণ করলেন। এরপর ব্যান্ড ও স্লোগানে মুখরিত এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা কিনব্রিজ পার হয়ে লামাবাজারে গাজী সাহেবের বাসার সামনে এসে থামল। নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ মুজিব বাসার ভেতরে ঢুকলেন। এক সম্মোহনী ক্ষমতায় এতটাই আবিষ্ট হই, গাজী সাহেবের বাসা ছাড়তে মন চাইছিল না। ভেতরে ঢুকলাম। পোশাক পাল্টানোর আগে বাদক দলের হাতে এক শ টাকার দুটি নোট তুলে দিলেন। ব্যান্ডের অনবদ্য পারফরম্যান্সে নেতা খুব খুশি। একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে ঘণ্টাখানেক নেতার সান্নিধ্যে কাটিয়ে বের হলাম রেজিস্ট্রি মাঠের দিকে। ওখানে বিকেলের জনসভায় ভাষণ দেবেন শেখ মুজিব।
এরপরের ঘটনাগুলে ইতিহাসের স্মরণীয়, অমলিন অধ্যায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, ‘শেখ মুজিব’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’, সত্তরের নির্বাচন, সাতই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী, একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রাম, ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে জাতির জনক।
একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেল। রেডিওতে ভেসে এল চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদ। হানাদার জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্ত ঢাকা। মুক্ত বাংলাদেশ। চারদিকে বিজয়ের গান। আনন্দ-উল্লাস।
এক দিন, দুই দিন যেতেই অনুভূত হলো এ বিজয় অসম্পূর্ণ। ফিকে-পানসে। কী যেন নেই। কিসের অতৃপ্তি? দেশটি যে স্বাধীন করলেন সেই মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। তাঁকে ছাড়া কি বিজয় পূর্ণতা পায়? আনন্দ-উল্লাস প্রাণস্পর্শী হয়? না। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী। আত্মসমর্পণ করলেও হানাদাররা তাঁকে মুক্ত করছে না। দিন যাচ্ছে, সপ্তাহ যাচ্ছে, ডিসেম্বর পার হতে যাচ্ছে, সারা জাতির মধ্যে উৎকণ্ঠা। বঙ্গবন্ধু কবে ফিরবেন। পাকিস্তানি জান্তা কখন মুক্তি দেবে। এর মধ্যে এল দুঃসংবাদ। ক্ষুব্ধ-স্তম্ভিত সবাই। যন্ত্রণার প্রহর গুনছেন। খবর এল, পাকিস্তানি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবে। জেলের ভেতর এর প্রস্তুতি চলছে। (পরে জানা গিয়েছিল কবর খোঁড়া ও জল্লাদও ঠিক করা হয়েছিল)। এমন খবরে কি স্থির থাকা যায়? চারদিকে চাপা কান্না। দোয়া ও প্রার্থনা।
মোগলাবাজারে আমাদের বাড়ির এক কোণে ছিল ছোট মসজিদ। বাবা জীবিত থাকাকালে সে মসজিদে নিয়মিত নামাজ হতো। ভোরবেলা বাবা জাগিয়ে দিতেন, আজান দিয়ে ফজরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করতাম। বাবার মৃত্যুর পর মসজিদ ঘরটি ভেঙে পড়লে কেউ তা মেরামত করেনি। তবে জায়গাটুকু বেড়া দিয়ে সংরক্ষিত ছিল। ফ্লোরের কিছু অংশ পাকা ছিল। মাঝে মাঝে সেখানে আমি নামাজ পড়তাম।
বঙ্গবন্ধুর জন্য এক অজানা ভালোবাসায় আমি প্রচণ্ড আবেগে আপ্লুত। কী করব বা করতে হবে বুঝে উঠতে পারছি না। পুকুরের ঘাটে অজু করে উন্মুক্ত মসজিদে ঢুকলাম। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে হাত তুললাম। হে আল্লাহ, বঙ্গবন্ধুকে তুমি ফিরিয়ে দাও। কবুল করো আমার দোয়া। বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে দাও। হে আল্লাহ, কবুল করো আমার দোয়া। হে আল্লাহ...। সেজদায় পড়েও একই প্রার্থনা—হে আল্লাহ, বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে দাও। সেজদায় কতক্ষণ ছিলাম জানি না। হঠাৎ অনুভব করি আমার চোখে পানি। আমি কাঁদছি। হু হু করে। অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আমি কাঁদছি।
কী হলো আমার। পিতা নন, চাচা-মামা, ভাই-দাদা কেউ নন। নন রক্তের আত্মীয়। অথচ কী গভীর ভালোবাসা। আর এত কান্না।
কারণ, তিনি ‘জাতির পিতা’। বিশ্বে মাথা উঁচু করে আজ বলছি আমি বাঙালি। আমার দেশ বাংলাদেশ। আর এ গর্বের সবটাই তো তাঁর—হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা। যিনি আছেন আমার হৃদয়জুড়ে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক