নারীদের পাশে পুরুষেরা
নারী কখনো মা, কখনো বোন, কখনো প্রেমিকা, কখনো স্ত্রী। নারীই কন্যা, বন্ধু। নিজের পরিবারের নারী বা পরিবারের বাইরের নারী সবাইকেই সম্মান করতে হবে। এই শিক্ষা আসে মূলত পরিবার থেকে। পরিবারের কর্তা বাবা যখন মাকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন, তখন সন্তানের মনেও সম্মান ও ভালোবাসা তৈরি হয়। তখনই সে বুঝতে পারে নারীর প্রতি সম্মান দেখানো কত জরুরি।
ব্রুকলিন বাইক পেট্রল এর জন্মদাতা জে রুইজ একজন ল্যাটিনো। পোর্টারিকো থেকে আসা পিতামাতার সন্তান। ৪৮ বছর বয়স্ক জে’র বলতে গেলে প্রসপেক্ট হাইটসে সারা জীবন কেটেছে। তাঁর বাবা রুবেন রুইজ ছিলেন ২৫০ পাউন্ড রেসলার। বাবা ২০০৬ এ পরলোকে পাড়ি দেন। তার বাবা তাকে শিশু বয়সে শেখান-‘তোমার মা আর বোনদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে। যাই করো না কেন কখনো কোনো মেয়েকে আঘাত করবে না। মেয়েদের সম্মান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।’এই মানসিকতা নিয়েই বেড়ে ওঠেন জে রুইজ।
জে রুইজ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১, টেলিভিশনের খবরে দেখলেন পার্ক স্লোপের ফোর্থ অ্যান্ড ফিফথ অ্যাভিনিউর কাছে এক নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সেই নারীর হৃদয়বিদারক কান্না জের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। নারীটির চিৎকার ও কান্না শুনে কেউ সাহায্য করতে আসেনি। তখনই তার মনে একটা ভাবনা আসে। জে তার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। “যাঁরা অবস্থাপন্ন তারা কার সার্ভিস ডেকে বাড়ি যেতে পারে। কিন্তু যাঁরা হেঁটে বাড়ি যায় আমরা আমাদের সেই নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারব।” এই মনোভাব নিয়েই ‘ব্রুকলিন বাইক পেট্রল’ চালু করেন। জে বলেন যে, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার বাইক নিয়ে উল্কার গতিতে পৌঁছে বিপদাপন্ন নারীকে নিরাপত্তা সহকারে তার বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। এটুকু আমি করতেই পারি।’
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, জে রুইজ তার ট্রেক ৪৩০০, ৪ প্রিয় বাই সাইকেলে উঠে এক বন্ধু সহ ফোর্থ অ্যাভিনিউ নাইনথ স্ট্রিট সাবওয়েতে গিয়ে একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দিলেন।
*ব্রুকলিন বাইক পেট্রল*
নিজের নাম ও ফোন নম্বর এবং ইমেইল নিচে।
আমরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিই।
যেই ভাবা সেই কাজ, পরদিন থেকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্রুকলিন বাইক পেট্রল গড়ে তোলেন জে রুইজ নামে একজন হিস্পানিক আমেরিকান। এর উদ্দেশ্য হলো নারীরা যাঁরা সাবওয়ে বা বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন তাদের নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেন। এর একটা ফেসবুক পেজ আছে। ফোন নম্বর দেওয়া আছে। কোনো নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে ওই নম্বরে কল করে বা টেক্সট মেসেজ করে সাহায্য চাইলে নিরাপত্তা রক্ষীর মতোই পাহারা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথম দিকে মানুষ ভাবতে লাগল যে জে রুইজ পাগল। যে কিনা দশ বছর যাবৎ ম্যানহাটনে বাইক-মেসেঞ্জার ছিল। ওরা ভালো না মন্দ এ নিয়েও সংশয় ছিল। একটি মেয়ে বলে-‘তোমাদের আমি কেন বিশ্বাস করব?’ তখন একদিন বারোজন বাইকসহ ৭২ নম্বর পুলিশ প্রিসিঙ্কটে গিয়ে সবার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলেন। এবং দেখা গেল এরা সকলেই সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। ইতিহাসে তারা ভালো বলেই প্রমাণিত ।
মূলত জে ছিলেন ছাব্বিশ বছর আর্মির কর্পোরাল যিনি তিন বছর আগে ফিরে এসে বাইক মেসেঞ্জার ব্যবসা শুরু করেন । যিনি বাইকে মাত্র ১১ মিনিটে ক্যানাল স্ট্রিট থেকে এইটি সিক্স অ্যান্ড ব্রডওয়ে পৌঁছে যেতে পারতেন। তাঁর দ্রুতগতির জন্য সহকর্মীরা তাঁকে ‘রকেট’ নাম দিয়েছিল। জে রকেট রুইজ। প্রতিদিন কাজে যাওয়া-আসা এগারো মাইল। আর বিপদাপন্ন নারীদের সহায়তা করার জন্য আরও পনেরো মাইল তিনি বাইক রাইড করে থাকেন।
এঁরা ব্যাটম্যানের মতো সুপার হিরো না কিন্তু এঁদের মনে সাহস আছে এবং তাঁরা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা সহকারে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে থাকে। একদিন সৌভাগ্য বশত ‘নিউজ ১২’ এর একটি ভ্যান এসে সাক্ষাৎকার নেয়। পরবর্তী সময়ে ‘নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজে’র একজন সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নেয়। কভার স্টোরি করার পরই এগিয়ে আসে অনেকগুলো সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান। এখন তাদের সঙ্গে পুলিশ, স্থানীয় কমিউনিটি, চার্চের দৃঢ় বন্ধন আছে ।
ব্রুকলিন বাইক পেট্রল (বিবিপি) তার স্বনামে, সুখ্যাতিতে এগিয়ে চলেছে ভয়ার্ত নারীদের অন্ধকার রাতে বা মধ্য রাতে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্ব সমাপন করে। ব্রুকলিন বাইক পেট্রল ১১ টি বাইক নিয়ে ১১ জন স্বেচ্ছাসেবক ১১ টি সাবওয়েতে তাদের কাজ শুরু করে ছিল। যা পরবর্তীতে ৩৫ টিতে উন্নীত হয়। বেড স্টাই (Bed-stuy), ক্যারলগার্ডেন, ক্লিনটন হিল, কোবল হিল, ফোর্ট গ্রিন, কেনসিংটন, পার্ক স্লোপ, প্রসপেক্ট হাইটস, সানসেট পার্ক, উইন্ডসর টেরেস, বরোপার্ক, ডি লাইনের পাঁচটি সাবওয়েতে ১১ টি স্পটে।
সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। শুক্রবার থেকে রোববার রাত আটটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এই নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্য অব্যাহত থাকে। নিরাপত্তাহীনতায় থাকা যেকোনো নারী ফোন, টেক্সট, ইমেইল বা ফেসবুক মেসেঞ্জার করে শুধু জানালে হবে যে কোনো সাবওয়ে থেকে তাদের সহায়তা লাগবে। রুইজ বলেন, ‘আমরা আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। আমরা এই নিশ্চয়তা দিতে চাই যে ব্রুকলিনের মেয়েরা যেন পথে কোনোভাবে আক্রান্ত না হয়। নিরাপদে ঘরে ফেরে। পাঁচ থেকে বিশজনকে প্রতিরাতে সাহায্য করে এই ব্রুকলিন বাইক পেট্রল। কোনো পেমেন্ট বা টিপস তারা নেয় না।’
ব্রুকলিন বাইক পেট্রল এর পেছনে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের চিত্র সামনে এলে দেখা গেল এরা সবাই ল্যাটিনো। জে রুইজ বলেন যে ল্যাটিনোরা খারাপ না এরা ভালো কাজ করছে, এটা জানুক সবাই। আমি এই চিত্রটি সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। বিবিপি যতই বিশ্বস্ততায় এগিয়ে যেতে লাগল কমিউনিটির সাহায্যের হাতও এগিয়ে এল। ইতিমধ্যে সেন্ট জেভিয়ার চার্চ, সিক্স্থ অ্যাভিনিউ ‘ব্রুকলিন বাইক পেট্রল’ লেখা পঁচিশটি হলুদ শার্ট ডোনেট করে। গাওনোসের একটি বাইকশপ বিনা মূল্যে বিবিপির সব বাইক মেরামত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অক্টোবরে স্টেট সিনেটর এরিখ ২৫ টি নিওন সাইনযুক্ত হলুদ বাইক-জ্যাকেট দেন সংগঠনটিতে; যা সাইকেল পোশাক নির্মাতা অ্যান্ডুরা কর্তৃক নির্মিত ।
তবে সত্য হলো এই যে জে রুইজ আর তাঁর স্বেচ্ছাসেবকেরা বিনা মূল্যে কাপড় আর বাই সাইকেল পাওয়ার জন্য বা খবরের কাগজে শিরোনাম হওয়ার জন্য কাজ করেন না। তাঁরা ব্রুকলিনের মেয়েদের সত্যিকার সাহায্য দেওয়ার জন্য কাজে নেমেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন এভাবেই তাঁরা ভালো কিছু করবেন। ব্রুকলিনের মেয়েরা যদি একাকী হেঁটে বাড়ি ফিরতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করো তাহলে ডায়াল করো- ৭১৮-৭৪৪-৭৫৯২ নম্বর এবং জানাও যে তোমরা নিজেকে নিরাপদ মনে করছ না। সাহায্য করার জন্য তৈরি ব্রুকলিন বাইক পেট্রল।