ট্রাম্প-কিম বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার কারণ তবে এই!
কোনো সমঝোতা ছাড়াই বহুল আলোচিত শীর্ষ বৈঠকটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বলা ভালো, ভেস্তে গিয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের মূল বৈঠকের আগে এত আলোচনা, দফায় দফায় কর্মকর্তাদের বৈঠক, প্রস্তুতি—তারপরও পরিণতি কেন এমন হলো, এ নিয়ে মুখ খোলেনি কোনো পক্ষই। মোটাদাগে শুধু বলা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিরোধের জেরেই সমঝোতা ছাড়া শেষ হয় হ্যানয় বৈঠক। উত্তর কোরিয়ার দাবি অনুযায়ী দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে রাজি হয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ওই বৈঠকের এক মাস পর আজ শনিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা দাবি যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের ধরিয়ে দেওয়া এক নথি নিয়ে ওই দিন বেজায় ক্ষুব্ধ হয় উত্তর কোরিয়া।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারি ভিয়েতনামের হ্যানয়ে ট্রাম্প-কিম বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার দিন ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতাকে সোজাসুজি একটি নথি ধরিয়ে দেন। নথিতে লেখা ছিল, পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক অস্ত্র ও বোমা–জ্বালানি হস্তান্তর করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। রয়টার্স সেই নথি দেখেছে।
হ্যানয়ের মেট্রোপোল হোটেলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে ইংরেজি সংস্করণের কপি কিমকে দেন ট্রাম্প। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত এক ব্যক্তি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সূত্রমতে, ওই দিন প্রথমবারের মতো ট্রাম্প পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ বলতে তিনি কী চান, তা বিশদভাবে কিমের কাছে তুলে ধরেন।
হ্যানয় বৈঠকে ধারণা করা হচ্ছিল, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে অগ্রগতি হবে। ওই দিন হোয়াইট হাউসের কর্মসূচির তালিকায় ছিল একটি যৌথ সমঝোতা স্বাক্ষর কর্মসূচি এবং দুই নেতার দুপুরের ভোজ। তবে বৈঠকটি কোনো সমঝোতা ছাড়া শেষ হওয়ার পর দুটোই বাতিল হয়ে যায়। এ নিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার ইয়াংবিয়ন পারমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার পরিবর্তে দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি করেছেন কিম জং–উন। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত নয়।
তবে কেন সম্মেলনটি এভাবে শেষ হয়ে গেল, তা নিয়ে দুই পক্ষের কেউ আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।
রয়টার্সের মতে, এই নথি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্প-কিমের দুদিনের ওই বৈঠক শেষে টেলিভিশনে দেওয়া হোয়াইট হাউস জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনের সাক্ষাৎকারে এই নথির অস্তিত্বের কথা প্রথম জানা যায়। তবে সাক্ষাৎকারে ওই নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ও ফিসাইল (যেসব পদার্থ পারমাণবিক চুল্লিতে বিদীর্ণ করা যায়) হস্তান্তরের ব্যাপারে কেন্দ্রীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কী প্রত্যাশার কথা উল্লেখ ছিল, তা তিনি প্রকাশ করেননি।
বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে বল্টনের দীর্ঘ সময়ের শক্ত অবস্থানের প্রকাশ ঘটেছে ওই নথিতে। ‘লিবিয়া মডেল’–এর ওই নথিতে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, যা বারবারই প্রত্যাখ্যান করে আসছে উত্তর কোরিয়া। এটাকে হয়তো কিম অপমানজনক ও উত্তেজনাকর বলে মনে করে থাকতে পারেন।
বল্টনের এই প্রস্তাবের ব্যাপারে এর আগে ট্রাম্প এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো না গেলেই কেবল ‘লিবিয়া মডেল’ প্রযোজ্য হতে পারে।
সাত বছর আগে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও লিবিয়ার নেতা মুহাম্মদ গাদ্দাফির মধ্যে। ওই সময় গাদ্দাফির সরকারের বিরুদ্ধে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়। পরে গাদ্দাফিকে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় এবং হত্যা করে।
গত বছরের জুনে ট্রাম্প-কিমের সিঙ্গাপুর বৈঠকের আগে উত্তর কোরিয়ার নেতারা বল্টনের পরিকল্পনাকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করে এবং গাদ্দাফির পরিণতির কথা তুলে ধরে। উত্তর কোরিয়া সিঙ্গাপুরের বৈঠকটি বাতিল করার হুমকি দিলে মে মাসে ট্রাম্প জানান, তিনি ‘লিবিয়া মডেল’ নিয়ে জোর দিচ্ছেন না এবং তিনি এমন একটি চুক্তি করার কথা ভাবছেন, যা কিমকে সুরক্ষিত রাখবে।
উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র হস্তান্তরের এই ধারণা ২০০৪ সালে প্রথম প্রস্তাব করেন বল্টন। গত বছর ট্রাম্প তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করার পর প্রস্তাবটি তিনি আবার তুলে ধরেন।
সূত্রমতে, ওই নথিতে উত্তর কোরিয়াকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয় যে যুক্তরাষ্ট্র ‘চূড়ান্ত, সম্পূর্ণ যাচাইযোগ্য, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ’ সম্পর্কে কী বোঝাতে চাইছে।
এই নথির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া দেয়নি হোয়াইট হাউস। আর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
হ্যানয় বৈঠক শেষে উত্তর কোরিয়ার এক কর্মকর্তা জন বল্টন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর দাবিকে ‘গ্যাংস্টারের মতো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি জানান, পিয়ংইয়ং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা বাতিলের চিন্তা করছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে নিজেদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রাখবে, না তুলে ফেলবে, তা নিয়ে ভাবছে।
নথির ইংরেজি সংস্করণে বলা হয়েছে, ‘উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অবকাঠামো, রাসায়নিক ও জীববিদ্যাসংক্রান্ত যুদ্ধ কর্মসূচি, এর সঙ্গে সম্পর্কিত দ্বৈত সক্ষমতা এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, লাঞ্চার ও সহযোগী সুযোগ-সুবিধা সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে হবে।’