এলিসের কথা
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউজার্সিতে ঈশান যখন পিএইচডি শুরু করল তখন সময়টা ছিল ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর। আমেরিকায় ওর তখনই প্রথম আসা। পিএইচডির সময়টাতে ঈশানকে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের ক্লাস নেওয়া লাগত। প্রতি সেশনে দুটি ক্লাস। গবেষণার পাশাপাশি এই ক্লাস নেওয়া, সঙ্গে অফিস সময়—সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটতো তার।
কাজ শেষ করে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা বা কখনো কখনো রাত হয়ে যেত।
প্রথম সেশনে ক্লাস নিতে গিয়ে ঈশানকে অনেক কষ্ট করতে হল। তবে পরের সেশন থেকে তা সহজ হয়ে গেল। একই কোর্স বলে, নতুন করে ক্লাসের আগে তেমন প্রস্তুতিও নেওয়া লাগত না। এই সময়টা সে তখন গবেষণায় দিতে পারত।
তৃতীয় সেশন যখন শুরু হল তখন গ্রীষ্ম মৌসুম। পুরো নিউজার্সি তখন প্রচণ্ড গরমে অসহ্য। সেই গরমে ঈশানকে একটা ক্লাস নিতে হল। তবে অন্য সেশনের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। মাত্র ১৩ জন। এর মধ্যে পাঁচজন ছেলে আর বাকিরা মেয়ে। ক্লাস নেওয়া ভালোই চলছিল। শিক্ষার্থীরা সবাই মেধাব, সহজেই পড়ানোর বিষয় বুঝতে পারে। তবে এর মধ্যে একটা মেয়ে কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের।
প্রথম কয়েক দিন অদ্ভুত ব্যাপারগুলো ধরা পড়েনি। অন্য ছাত্রীদের মতোই মনে হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার প্রথম ধরা পড়ে ক্লাসে প্রথম পরীক্ষার দিন। দুই ঘণ্টার পরীক্ষা। এই দুই ঘণ্টায় মেয়েটি তার খাতায় কিছুই লিখল না। আশপাশের কারও কাছ থেকে কিছু দেখার বা কথা বলার চেষ্টা না করে, পুরো সময়টা একটানা খালি খাতার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিল। ঈশান কিছু বলল না। সে তত দিনে বুঝে গেছে, এখানে নিজ থেকে কেউ কিছু না শিখতে চাইলে বা করতে চাইলে, জোর করা যায় না। ক্লাসে হাঁটতে হাঁটতে ঈশান মাঝে মাঝে কেবল মেয়েটির দিকে তাকাল। সময় শেষে মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে, অন্যদের মতো খাতা দিয়ে চলে গেল। ঈশান খাতাটি নেড়েচেড়ে দেখল। না, কিছুই লেখেনি! প্রথম পাতায় শুধু নামটি লেখা—এলিস জনসন।
এরপর থেকেই এলিসের অদ্ভুত ব্যাপারগুলো ঈশানের চোখে পড়তে লাগল। ক্লাসে অন্যমনস্কতা, কখনো কখনো একবারেই কারও সঙ্গে কথা না বলা, আবার কখনো কখনো উঁচু স্বরে কথা বলা, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা—এসব ব্যাপার স্পষ্ট ধরা পড়ল।। আশপাশের শিক্ষার্থীরাও এক সময় ওর ব্যবহারকে অস্বাভাবিক বলে মনে করতে লাগল। যদিও কেউ কোন অভিযোগ করল না।
গ্রীষ্ম মৌসুম দ্রুত চলে যাচ্ছিল। তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। এক দুপুরে ঈশান তার অফিসে বসে আছে। অফিস সময় ছিল, তবে কোন শিক্ষার্থী ছিল না। ঈশান তার টেবিলে ঝুঁকে গ্রেডিংয়ের কাজ করছিল। এমন সময় দরজায় হালকা টোকা। দরজা খোলাই ছিল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মধ্য বয়স্ক এক আমেরিকান সাদা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনের কাপড়-চোপড় অতটা পরিপাটি নয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সেই মুখে এক ধরনের ক্লান্তি ও বিষণ্নতা।
লোকটি হ্যালো বলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ঈশান আগন্তুককে ভেতরে আসতে বলল। সেই লোক ভেতরে এসে, একটা চেয়ারে বসে, তার পরিচয় আর আসার কারণ বলতে লাগল। বলল, ওনার মেয়ে ঈশানের ক্লাসের ছাত্রী, নাম এলিস জনসন।
ঈশান এলিসকে চিনতে পেরেছে মুখে তা ফুটিয়ে বলল, ‘আচ্ছা। তা কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?’
লোকটির হাতে একটা ফাইল। সে ফাইল থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে সামনে টেবিলের উপরে রাখল। ঈশান দেখল, ওগুলো কোন এক সাইকিয়াট্রিস্টের প্রেসক্রিপশন।
ঈশান কাগজগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে লোকটির দিকে তাকাতেই সে বলতে লাগলেন, ‘আমার মেয়ে ছোট বেলা থেকেই একটু অন্যরকম। আনমনা। মানুষের সঙ্গে কথা কম বলে। ওর যখন ১০ বছর বয়স, তখন ওর মা মারা যায়, আর তখন থেকেই এই স্বভাবটা আরও বেশি প্রবল হয়ে উঠে। পরে মানসিক ডাক্তার দেখানোর পরে বোঝা গেল, ও আসলে খারাপ ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত।’
ঈশানের অস্বস্তি লাগছিল। চোখে-মুখে তা বুঝতে না দিয়ে ভদ্রভাবে বলল, ‘ওর মানসিক সমস্যা নিয়ে অফিস অব একসেসিবিলিটি কথা বলাই ভালো। তেমন কিছুর প্রয়োজন হলে ওরাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’
‘আমি জানি, আর তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। তবে আমার মনে হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে দেখা করে বললে ভালো হয়।’
লোকটি যেহেতু বলতেই চাচ্ছে, ঈশান আর বাধা দিল না। বলল, ‘সমস্যাটা কি?’
এলিসের বাবা একটু দম নিয়ে বলতে লাগল, ‘রোগটার নাম বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। ওর ক্ষণে ক্ষণে আচরণের খুব পরিবর্তন হয়। এই হাসি-খুশি, একটু পরেই আবার চরম বিষণ্ন। চরম বিষণ্নতার সে সময়ে ও কারও সঙ্গে কথা বলে না। একা একা থাকে। ওর মনোযোগেরও প্রচণ্ড অভাব, কোন কিছুতেই কখনো বেশিক্ষণ ফোকাস থাকতে পারে না। কখনো কখনো এমন দেখা যায়, বই পড়তে পড়তে কোন এক পাতায় এসে আঁটকে রইল, আর সে পাতাতে তাকিয়ে থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিল। ওর এই মুহূর্তগুলোতে কেউ যদি কিছু বলতে আসে, ও তখন প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার করে। আরও ব্যাপার হচ্ছে, ও কারও সঙ্গেই কোন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। ওর মনে অন্যদের প্রতি একটা হীনমন্যতা কাজ করে। এলিসের ধারণা, সবাই তার চেয়ে অনেক হীন।’
এলিসের বাবা একটু থেমে আরও বলল, ‘আপনাকে ওর ডাক্তারের কাগজগুলো দিয়ে গেলাম। পরে সময় করে দেখবেন। ওর সম্পর্কে আশা করি কোন ভুল ধারণা হবে না।’
ঈশান বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি প্রেসক্রিপশনগুলো দেখব। চেষ্টা করব, ওর যেভাবে শিখতে সহজ হয়, তেমন পরিবেশ তৈরি করতে। চিন্তা করবেন না।’
লোকটি এগিয়ে এসে করমর্দন করে ধন্যবাদ বলে চলে গেল। লোকটির হাঁটার ভঙ্গিতে অসহায়ভাব। মেয়ের মানসিক ব্যাধি যেন তাকে খুব চিন্তিত করে তুলেছে।
খুব ব্যস্ততার সঙ্গে সে সেশন শেষ হয়ে গেল। এলিস ক্লাসে ফেল করল। ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অন্য কোর্সগুলোতেও একই অবস্থা। সে সেশনের পরেই এলিস ইউনিভার্সিটি থেকে ড্রপ আউট হয়ে গেল। পরের সেশনে নতুন ছাত্রদের নিয়ে ঈশান ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এলিসের কথা একেবারেই ভুলে গেল সে।
প্রায় দেড় বছর পর হটাৎ একদিন কাঁকতালীয়ভাবে আবার এলিসের সঙ্গে ঈশানের দেখা হল। তখন শীতের মৌসুম, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। স্কুল কলেজের সেশন সব শেষ—চারপাশে বড় দিনের আবহ।
সেদিন সকাল থেকেই তুষারপাত হচ্ছিল। আবহাওয়া খুব খারাপ। ঈশানের সেদিন বাসার জন্য কী একটা জরুরি জিনিস কেনার দরকার পড়েছিল, ফেল তাকে যেতে হয়েছিল হোম ডিপোটের মতো বড় দোকানে। হোম ডিপোট বাসা থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে। সেই আবহাওয়ায় ১০ মাইল ড্রাইভ করেই ওকে যেতে হল।
হোম ডিপোটে অনেক ঘুরে জিনিসটা কিনে চেক আউট করতে গিয়ে ঈশান অবাক হয়ে দেখে সেখানে এলিস দাঁড়িয়ে। এলিস ওকে সহজেই চিনতে পারল। চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ঈশানের সঙ্গে ওর কিছুক্ষণ কথা হল। কেমন আছে, ক্লাস নেওয়া কেমন চলছে—এসব জানতে চাইল। এলিস অস্বস্তিতে পড়তে পারে ভেবে ঈশান ওকে পড়াশোনা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করল না। কেমন আছে, ইদানীং কি করছে—কেবল এসব জিজ্ঞাসা করল। এলিস বলল, ও এখানে ছয় মাস ধরে কাজ করে। পাশের এলাকায় একটা বাসা ভাড়া করে থাকে। পরে এলিস অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই, ওর বাসা সম্পর্কে বলে যেত লাগল। বাসাটা শহর থেকে একটু দূরে। কিছুটা গ্রামীণ এলাকায় হলেও খুব চমৎকার—এ সব।
ঈশান মুখে উৎফুল্ল ভঙ্গি করে বলল, ‘হুম, দারুণ তো!’ তবে মনে মনে ওর কাছে মনে হল, মেয়েটির মানসিক সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। হঠাৎ করে বাসা সম্পর্কে বলতে থাকাটা খুব অদ্ভুত ও খাপছাড়া। হয়তো এভাবে কথা বলার ধরনটাও ওর সেই মানসিক ব্যাধিরই একটা চিহ্ন।
এলিস ওর বাসা সম্পর্কে বলতে বলতে এতটাই উত্তেজিত যে, কথা বলার শেষে এক সময়ে ঈশানকে বাসায় আমন্ত্রণই করে বসল। বলল, ‘সামনের শনিবারে আসতে পারো।’
ঈশান অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে না বলাটা অভদ্রতা। একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে।’ এলিস খুব আগ্রহ নিয়ে ওর বাসার ঠিকানা দিল।
শনিবার বিকেলে সিক্স প্যাক বিয়ার কিনে ঈশান এলিসের বাসার দিকে রওনা দিল। আবহাওয়ার অবস্থা তখনো ভালো হয়নি। চারপাশ ঘোলাটে, কুয়াশাচ্ছন্ন-সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বাড়িটা অনেক দূরে। শেষ এক্সিট নিয়ে রাস্তায় নামার পর দেখা গেল, এলাকাটা প্রায় জনহীন। অনেক দূর পর পর ছোট ছোট ঘরবাড়ি, আর জঙ্গলের মতো। গাড়ি চালাতে চালাতে ঈশানের মনে হল, এ রকম একটা বাড়িই হয়তো হবে। ধীরে ধীরে চলতে লাগল। কয়েকটা বাড়ি পার হতেই এলিসের বাড়িটা পাওয়া গেল।
দোতলা পুরোনো বাড়ি। বাড়ির চারপাশ খোলামেলা। দরজার বাইরে কোন কলিং বেল নেই দেখে ঈশান দরজায় টোকা দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দোতলা থেকে কারও নেমে আসার শব্দ পাওয়া গেল। এলিস দরজা খুলল, তবে ওর মুখে আতিথেয়তার কোন হাসি নেই। ঈশান সিক্স প্যাক বিয়ার ওর হাতে দিল। এলিস তেমন কিছু না বলে ওকে কেবল ফলো করতে বলল। ঈশানকে দোতলার ঘরে নিয়ে গেল।
ঘরটা খুব সুন্দর। তিনটি বড় বড় জানালা। তা দিয়ে বাইরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।
ঘরের একপাশে বিশাল এক বুকশেলফ—তাতে বই ভর্তি। জানালার পাশে একটা সোফা, সামনে নিচু একটা কাচের টেবিল। একটা বই খোলা অবস্থায় তাতে পড়ে আছে। পাশেই একটা গ্লাস। তাতে অল্প ওয়াইন। পুরোনো বই আর ওয়াইনের গন্ধ একসঙ্গে হয়ে ঘরের বাতাসে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ।
বুকশেলফে রাখা বইগুলোতে ঈশান চোখ বুলাল। বেশির ভাগ বই-ই কবিতার বলে মনে হল। কয়েকজন পরিচিত কবির নামও ঈশানের চোখে পড়ল। সামনে টেবিলে খোলা অবস্থায় যে বইটা পড়ে আছে, তাও একটা কবিতার বই।
এলিস ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। ঈশান পাশের একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘তুমি কি অনেক বই পড়?’
এলিস গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, ‘অনেক পড়ি না। যখন ভালো লাগে তখন পড়ি।’
ঈশান বলল, ‘কি ধরনের লেখা তোমার পছন্দ?’
এলিস ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে, জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টি ফেলে শান্ত স্বরে বলল, ‘কবিতাই বেশি ভালো লাগে। নির্জনতার কবিতা’।
“হুম। উপন্যাস বা প্রবন্ধ এগুলো পড় না?”
জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে ঈশানের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, পড়ি, মাঝে মাঝে। তবে আমি ওসবের এত ফ্যান না।’ পরে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘অনেকেই আমাকে বলে, নির্জনতার সে সব কবিতাই নাকি আমাকে বিষণ্ন করে রাখে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, বিষণ্নতার জগতে যে এক ধরনের আনন্দ আছে, এসব কবিতা আমাকে তাই দিয়েছে, আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ এসব কথা বলতে বলতে এলিস কিছুক্ষণ পর পর বাইরে তাকায়। সে দৃষ্টি অসম্ভব রকমের বিষণ্নতায় ভরা। আর তা কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে।
আরও কিছুক্ষণ টুকিটাকি অনেক বিষয়ে কথা হল। এলিসের বাসা থেকে ঈশান যখন বের হয়ে এল, তখন রাত নয়টা। ওর কাছে মনে হল যেন বিষণ্নতার এক জগৎ থেকে বের হয়ে এল। বিষণ্নতা যে কত ভয়ংকর হতে পারে ঈশান বুঝল।
সেই ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময় আরও একবার এলিসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ইউনিভার্সিটির পাশের রাস্তা দিয়ে ঈশান হেঁটে যাচ্ছিল। রাস্তার অপর পাশে ভার মুখে এলিস দাঁড়িয়ে। দেখতে পেয়ে দুজন কেবল হাত নেড়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি। এর প্রায় পাঁচ বছর পরের কথা। ঈশান ফিলাডেলফিয়া বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল। একটি সেমিনারে ওয়াশিংটন যাবে। সময় কাটানোর জন্য হাতে একটা বই। পড়ার এক ফাঁকে মুখ তুলে তাকাতেই সামনের দুই সারি চেয়ারের পরেই মনে হল পরিচিত কেউ একজন বসে আছে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝল এলিস। এলিসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। এলিস ঈশানকে চিনল, হেসে হাত নাড়াল। এ কয় বছরে এলিসের চেহারায় বয়সের যেন কোন ছাপই পড়েনি, বরং আরও কমেছে।
ঈশান কাছে গিয়ে কেমন আছে, কোথায় আছে জানতে চাইল। এলিস বলল, ভালো। আবার ও পড়াশোনা শুরু করেছে। সামনের বছরই গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। বিয়েও করেছে বছর তিনেক আগে। বাচ্চা আছে দুটি। টুইন।
বাচ্চা দুটি একটু দূরে খেলা করছিল। ওদের সঙ্গে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা এক ভদ্রলোক। ঈশান বুঝল, উনিই হয়তো এলিসের স্বামী। এলিস হাত নেড়ে ইশারা করতেই লোকটি দুই বাচ্চাকে দুই হাতে ধরে কাছে এল। খুব ফুটফুটে আর অস্থির বাচ্চা দুটি। বারবার মাম্মি মাম্মি বলে এলিসের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এলিস ওর স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, আর ঈশানকে কীভাবে চিনে বলল। লোকটি বেশ ভদ্র আর খুব মিশুক প্রকৃতির। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে, ঈশানকে কফি খাওয়াবে বলে সামনের একটা কফি শপে নিয়ে গেল। সঙ্গে এলিস আর বাচ্চা দুটো। কফি খেতে খেতে কথা বলতে বলতে এলিসের হাসিমাখা মুখ দেখে ঈশানের বড় ভালো লাগল। কথার মাঝে প্রায়ই দেখা গেল, এলিস স্বামীর কাঁধ চাপড়ে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার সতর্ক দৃষ্টিতে বাচ্চাদের দিকেও খেয়াল রাখছে। এলিসের সেই ভয়ংকর বিষণ্ন আর উদাসীন দৃষ্টি ঈশানের এখনো মনে আছে। সেই সব বিষণ্নতা কাটিয়ে, স্বামী আর দুটি বাচ্চা নিয়ে আজকের প্রাণবন্ত এক এলিস।
কথা বলতে বলতে ঈশানের প্লেনের সময় হয়ে গেল। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, ব্যাকপ্যাক কাঁধে ফেলে ঈশান বোর্ডিংয়ের লাইনের দিকে চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে একসময় কি মনে করে যেন ফিরে তাকাল। দেখল, এলিস হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আর বাচ্চা দুটো তখনো বায় বায় বলে হাত নাড়াচ্ছে। দৃশ্যটা খুব সুন্দর, মন ভরে গেল। ঈশান ভাবল, বছর পাঁচেক আগের সে সন্ধ্যায় দেখা বিষণ্ন এলিসের সঙ্গে আজকের এই হাসিখুশি এলিসের কতই না পার্থক্য!