মার্কিন নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা ততই আরও বেশি করে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সমর্থনের ওপরে নির্ভর করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাঁর নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার কেবল নৈতিকতাবিরোধী নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী।
রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলনের তিন দিনে বক্তাদের বক্তৃতায় এটা স্পষ্ট যে মধ্যপন্থীদের আকর্ষণ করা দলের লক্ষ্য নয়, দল চাইছে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকদের ধরে রাখতে। সে জন্য নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষের দল হিসেবে হাজির করছে এবং আরও বেশি দক্ষিণপন্থীদের কাছে আবেদন তৈরি করতে সচেষ্ট হচ্ছে। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন কমিটির সদস্য কিম্বারলি গুয়েলফয়েল, হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ সদস্য ম্যাট গেইজ, ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্পসহ বেশ কয়েকজনের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট ছিল।
গেইটজের ভাষ্য অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাটরা বিজয়ী হলে ‘তাঁরা আপনাদের নিরস্ত্র করবে,
কারাগারগুলো খালি করে ফেলবে, আপনাদের ঘরে বন্দী করবে এবং এমএস-১৩কে আপনাদের ঘরের পাশে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে’। এমএস-১৩ হচ্ছে একটি অপরাধী চক্র, যাদেরকে রিপাবলিকানরা অভিবাসীদের অপরাধী চক্র বলে দেখাতে চায়।
আর গুয়েলফয়েলের ভাষ্য, ডেমোক্র্যাটরা মার্কিনদের স্বাধীনতাই ছিনিয়ে নেবে।
কঠিন সত্য হচ্ছে, জো বাইডেনের (ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী) আমেরিকায় আপনি নিরাপদ থাকবেন না।
ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স গত বুধবার রাতে বলেছেন, ‘কঠিন সত্য হচ্ছে, জো বাইডেনের (ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী) আমেরিকায় আপনি নিরাপদ থাকবেন না।’ পেন্সের বক্তৃতায় কয়েক মাস ধরে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও নাগরিকের সমান অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল কথা তো বলাই হয়নি, উপরন্তু এসব আন্দোলনকে সহিংস বলে চিত্রিত করা হয়েছে এবং উচ্চারিত হয়েছে হুঁশিয়ারি—‘এ বিষয়ে আমি স্পষ্ট করে বলি, সহিংসতা বন্ধ হতে হবে, তা মিনিয়াপোলিস, পোর্টল্যান্ড বা কেনোশায়—যেখানেই হোক।’
উইসকনসিন রাজ্যের কেনোশায় নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জ্যাকব ব্ল্যাককে গত রোববার পুলিশ গুলি করার পর থেকে সেখানে বিক্ষোভ চলছে। মঙ্গলবার বিক্ষোভ চলাকালে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো গুলিতে দুজন মারা যান। গুলি চালানোর অভিযোগে একজন শ্বেতাঙ্গ যুবককে আটক করা হয়েছে। ইলিনয়ের অধিবাসী ১৭ বছর বয়স্ক কাইল রিটেনহাউসের সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প, পুলিশ বাহিনীর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছে এবং আগে ট্রাম্পের সমাবেশে যোগ দিয়েছে।
দেশের দক্ষিণপন্থীদের প্রতি পক্ষপাত ট্রাম্পের জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় উগ্র বর্ণবাদী সংগঠন ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের (কেকেকে) সাবেক প্রধান ডেভিড ডিউক ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন এবং সংগঠনের সংবাদপত্র ক্রুসেডার তাঁদের প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিল। ট্রাম্পের প্রচারণা দল ক্রুসেডার-এর সমর্থন প্রত্যাখ্যান করলেও ট্রাম্প ডেভিড ডিউকের কোনো রকম সমালোচনা করতে অস্বীকার করেন। সেই সময়ে অল্ট-রাইট এবং তার প্রতিনিধি টেভ বেনন ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণা চালান। অল্ট-রাইট বর্ণবাদী, ইহুদি ও ইসলামবিরোধী, অভিবাসীদের ব্যাপারে ঘৃণা ছড়ানোর জন্যই পরিচিত। বেনন ট্রাম্পের উপদেষ্টা হিসেবেও হোয়াইট হাউসে কাজ করেছেন।
এ বছর ট্রাম্প আরও কট্টর উগ্রবাদীদের দিকেই ঝুঁকছেন। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, দলের সম্মেলনের প্রথম দিনে গুরুত্বের সঙ্গে মার্ক এবং তাঁর স্ত্রী পেট্রিসিয়া ম্যাকক্লসকিকে উপস্থাপনা। মিজৌরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরের এই দম্পতি ২৮ জুন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই সময়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের পক্ষে করা একটি মিছিলের দিকে তাঁরা তাঁদের বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের (ফেলোনি) অভিযোগে মামলা দায়ের আছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তাঁরা শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র মিছিলকারীদের হুমকি দিয়ে বিপজ্জনক অবস্থার সূচনা করেছিলেন। এই আইনজীবী দম্পতি সম্মেলনের আগেও ট্রাম্পের জন্য অর্থ সংগ্রহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন।
এ ছাড়া কিউআনন বলে একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি ট্রাম্প অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ করেছেন। অ্যান্টি-সেমেটিক এই গোষ্ঠীটি বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করে, বর্ণবাদী প্রচারণা চালায় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে থাকে। এই গোষ্ঠীর তৎপরতাকে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই গত মে মাসে ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেছে। এই গোষ্ঠীর একজন সমর্থক মার্জোরি টেইলর গ্রিন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিনিধি সভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলের প্রাথমিক নির্বাচনে বিজয়ী হলে ট্রাম্প তাঁকে অভিনন্দন জানান। কিউআনন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প ১৯ আগস্ট বলেন, ‘আমি শুনেছি যে তাঁরা দেশকে ভালোবাসে।’
রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের ভেতরে ছয়জন অভিবাসীকে নাগরিকত্ব প্রদানের ও একজন সাবেক দণ্ডিত ব্যক্তিকে অনুকম্পা প্রদানের অনুষ্ঠান করে, যা প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে এবং একটি আইনের বরখেলাপ বলেও মনে করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে হোয়াইট হাউসের লন থেকে সম্মেলনে বক্তৃতা দেন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। দলীয় কারণে হোয়াইট হাউসের এই অভূতপূর্ব ব্যবহার ক্ষমতার অপব্যবহার বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের লন থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দলের মনোনয়ন গ্রহণ করার কথা ছিল।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার মানদণ্ড শিথিল করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সিডিসির (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) ওপরে চাপ দিয়েছে, যাতে করে আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখানো যায়।
এর আগে গত বুধবার নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, করোনাভাইরাস পরীক্ষার মানদণ্ড শিথিল করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সিডিসির (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) ওপরে চাপ দিয়েছে, যাতে করে আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখানো যায়।
# আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।