যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইতিমধ্যেই আগাম ভোট দিয়েছেন ৯ কোটির বেশি ভোটার। আশা করা হচ্ছে, আজ আরও কমপক্ষে আট-নয় কোটি মানুষ ভোট দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সর্বত্র ভোট নিরাপদে হবে কি না, কী হবে নির্বাচনের পর?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে দেশটির নাগরিকদের তো অবশ্যই, সারা বিশ্বের মানুষের উৎসাহ, আগ্রহ ও উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার উদ্বেগ–আশঙ্কা। অতীতে অনিশ্চয়তা ছিল ফলাফল নিয়ে—কে জেতেন, কে হারেন। কিন্তু সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিলেন, ফল যা–ই হোক, সে ফলাফলে নাগরিকেরা খুশি হন বা না হন, পরদিন তাঁরা দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাবেন।
তাঁরা অপেক্ষা করবেন ২০ জানুয়ারির, নতুন প্রেসিডেন্টের শপথের দিনের। কিন্তু এবার প্রশ্ন, সবার ভোট গণনা হবে কি না, কী হবে নির্বাচনের দিন, কী হবে নির্বাচনের অব্যবহিত পরে, সামনের দিনগুলোয় দেশ কোথায় যাবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন শহরে সহিংসতার আশঙ্কায় দোকানপাটের দেয়াল বোর্ড দিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে। কমপক্ষে ১০টি অঙ্গরাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড ইতিমধ্যে নির্বাচনবিষয়ক মিশনের জন্য পরিকল্পনা করেছে। আরও ১৫টিতে সেই ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছে।
কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে ডাকযোগে পাঠানো ব্যালট সময়মতো নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরবে কি না, সে নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে ডাক বিভাগের শ্লথগতির কারণে। ৩ নভেম্বরের পর পৌঁছানো ভোট গণনা নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান পার্টি মামলা করেছে। কিছু মামলার নিষ্পত্তিও হয়েছে অঙ্গরাজ্যের আদালতে। কিন্তু নির্বাচনের পর এসব মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে বলেও মনে হচ্ছে। রিপাবলিকান পার্টি টেক্সাসের হিউস্টন শহরে ড্রপবক্সে দেওয়া ব্যালট গ্রহণ না করার জন্য আদালতে গিয়েছিল। আদালতের রায় তাদের পক্ষে যায়নি। কিন্তু গত কয়েক মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি বলেছে, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আদালতের লড়াই নির্বাচনের পরও চালাবে। রিপাবলিকান পার্টি এবং ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই আইনিভাবে এবং আইনবহির্ভূতভাবে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার বিভিন্ন রকম চেষ্টা করছে। নির্বাচনের দিন তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটাই এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজে সব সময়ই বিভাজন ছিল। কিন্তু গত চার বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্রে যে মেরুকরণ ঘটেছে, এগুলো হচ্ছে তার পরিণতি। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিজেই এই নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্রিয় থেকেছেন। ভোট গণনার প্রাথমিক পর্যায়ে এগিয়ে থাকলে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বলেও খবর বেরিয়েছে।
তাঁর সমর্থকদের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকার কথা বলেছেন, যা সশস্ত্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের একধরনের উসকানি বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁদের ‘প্রস্তুত থাকতে’ বলেছিলেন।
এবার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর কারণ, ডাকযোগে পাওয়া বড় সংখ্যার ব্যালট। এই ধরনের বিলম্বকে জালিয়াতি এবং ফল বদলে দেওয়ার চেষ্টা আখ্যা দিয়ে ট্রাম্পের সমর্থকেরা গোলযোগ সৃষ্টি করবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই। প্রেসিডেন্ট নিজে কী ধরনের আচরণ করবেন, কী ধরনের টুইট করবেন, সে বিষয়ে এমনকি তাঁর ঘনিষ্ঠদেরও ধারণা নেই। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের। কিন্তু তাঁদের গত চার বছরের আচরণ থেকে আশা করা যায় না যে তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শক্ত অবস্থান নেবেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের সম্ভাব্য আচরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ-আশঙ্কা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন পরাজিত হলে তাঁর সমর্থকেরা সেটা মেনে নিতে রাজি থাকবেন কি না। নির্বাচনের দিন কোনো ধরনের বাধাবিঘ্ন ঘটলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা সচেষ্ট হলে যে সংঘাতের সৃষ্টি হবে, এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চিত করেই বলা যায়, সম্পূর্ণ বা আংশিক ফলাফল প্রকাশের পর যদি দেখা যায় যে ফল বাইডেনের সমর্থকদের অনুকূলে নেই, তাহলে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশের জন্য মিছিল করবেন। সেগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের গৃহীত ব্যবস্থা সারা দেশের বিভিন্ন শহরে গ্রীষ্মকালের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর সুযোগ নিতে পারেন নৈরাজ্যবাদীরা। তাতে দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটার আশঙ্কা থাকছে।
যেভাবেই বিবেচনা করি না কেন, নির্বাচনের অব্যবহিত পরে একধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা থাকছেই। কিন্তু সেটা যে কেবল প্রাণনাশের এবং সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করে, তা নয়, নির্বাচনের বৈধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরাজিত দলের সমর্থকেরা এটা মনে করবেন যে জালিয়াতি করে তাঁদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্ভাব্য জালিয়াতির কথা বলে জনমনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।
জালিয়াতির এই কথিত অভিযোগে যে দুই পক্ষই আদালতের দ্বারস্থ হবে, সেটা অনুমেয়। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এ রকম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বারবার। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার শেষ সময়ে এসে তিনি বলেছেন, তাঁর আইনজীবীরা প্রস্তুত আছেন।
যদিও এটা অনুমান করা হচ্ছে যে এই ধরনের মামলায় ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু তারপরও ডেমোক্র্যাটদের জন্য আদালতে যাওয়ার বিকল্প থাকবে না।
ফলে এক দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পাকচক্রে পড়তে পারে এবারের নির্বাচনের ফল। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র একধরনের সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে পড়বে।
যদিও এই সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায় সংবিধানের ভেতরই আছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে পড়েছিল ১৮৭৬ সালে। সে সময় দুই দলের মধ্যে আপসরফার মাধ্যমে পথ বেরিয়েছিল, যদিও তা কৃষ্ণাঙ্গদের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। তা ছাড়া সে সময় দুই পক্ষের আপস করার যে মানসিকতা ছিল, একটি বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রে এখন তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এসব অবস্থা কেবল তখনই এড়ানো সম্ভব হবে, যদি কোনো প্রার্থী বড় জয় নিশ্চিত করতে পারেন। এ ধরনের ফলাফলের একটি ইঙ্গিত ফল ঘোষণার শুরুতেই পাওয়া যায়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।