ফিরে দেখা
ছয় দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের প্রথম সরাসরি বিতর্ক কেমন ছিল
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক বলতে গেলে প্রধান নির্বাচনী প্রচার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা সাধারণত এ ধরনের একাধিক বিতর্কে অংশ নিয়ে থাকেন। এসব বিতর্ককে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক বলা না গেলেও ভোটের মাঠে এর প্রভাব যে ব্যাপক, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
এ ধরনের বিতর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, বর্তমান প্রেসিডেন্টে জো বাইডেনের নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা থেকে সেটি অনুমান করা যায়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গত ২৭ জুনের বিতর্কে হেরে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে তাঁকে সরে যেতে হয়েছে।
টেলিভিশন বিতর্কে প্রার্থীরা মূলত নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারই তুলে ধরেন। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের প্রার্থীর সিদ্ধান্ত ও নীতির সমালোচনার পাশাপাশি নিজের নীতি ও অঙ্গীকার তুলে ধরেন বিরোধী প্রার্থী। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন প্রার্থী দলের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে নিজে নতুন করে কী করবেন, ভোটারদের সামনে সেসব বিষয় তুলে ধরেন। মূলত, এ বিতর্কের মাধ্যমে বিশালসংখ্যক ভোটার ও দর্শকের সামনে নিজের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরার সুযোগ পান প্রার্থীরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক বিশ্বরাজনীতিতেও একধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
যেভাবে শুরু এই সরাসরি বিতর্ক
আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এটি সামনে রেখে ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের বিতর্কের এ ধারা ছয় দশকের বেশি পুরোনো। ছয় দশকের বেশি, অর্থাৎ ৬৪ বছর আগে আজকের এই দিনেই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের সরাসরি টেলেভিশন বিতর্ক। ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিবিএসের আয়োজনে শিকাগো স্টুডিওতে প্রথম এমন বিতর্কে অংশ নেন দুই প্রার্থী—তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও সিনেটর জন এফ কেনেডি।
মূলত এ বিতর্কের মাধ্যমে বিশালসংখ্যক ভোটার ও দর্শকের সামনে নিজের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরার সুযোগ পান প্রার্থীরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক বিশ্বরাজনীতিতেও একধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কেনেডি আর রিপাবলিকান প্রার্থী নিক্সনের এ বিতর্ক টেলিভিশনে দেখেছিলেন লাখো মানুষ। অনেকেই তখন বলেছিলেন, এ বিতর্ক একজন প্রার্থীর জয়-পরাজয় ঠিক করে দেবে।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের প্রথম টেলিভিশন বিতর্কের কথা এলে ১৯৫৬ সালের ৪ নভেম্বরের বিতর্কের বিষয়টিও সামনে আসে। সিবিএস আয়োজিত ‘জনগণের মুখোমুখি’ শীর্ষক এ বিতর্কে অংশ নেন ডয়েন এলেনর রুজভেল্ট ও মার্গারেট চেজ স্মিথ। বিতর্কে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাডলাই স্টিভেনসনের পক্ষে ডয়েন আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের পক্ষে মার্গারেট অংশ নেন। দুই নারীর এ বিতর্ককে অনেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক বলে থাকেন।
১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কের পর ১৬ বছর এ ধরনের বিতর্ক হয়নি। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি গুপ্তহত্যার শিকার হলে নতুন প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন বি জনসন। তবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে সরাসরি বিতর্কে রাজি হননি। একইভাবে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়া নিক্সনও সরাসরি বিতর্কে (১৯৬৮ সাল থেকে) অংশ নিতে রাজি হননি।
অবশ্য, ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কের পর ১৬ বছর এ ধরনের বিতর্ক হয়নি। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি গুপ্তহত্যার শিকার হলে নতুন প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন বি জনসন। তবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে সরাসরি বিতর্কে রাজি হননি। একইভাবে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়া নিক্সনও সরাসরি বিতর্কে (১৯৬৮ সাল থেকে) অংশ নিতে রাজি হননি।
কেমন ছিল প্রথম বিতর্ক
কেনেডি–নিক্সন বিতর্কের সঞ্চালক ছিলেন হাওয়ার্ড কে স্মিথ। দুই প্রার্থীকে প্রশ্ন করার জন্য স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন এনবিসি নিউজের প্রতিবেদক স্যান্ডার ভ্যানোকুর, মিউচুয়াল নিউজের চার্লস ওয়ারেন, সিবিএস নিউজের স্টুয়ার্ট নোভিনস ও এবিসি নিউজের বব ফ্লেমিং। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিতর্কটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
বিতর্ক শুরুর প্রায় এক ঘণ্টা আগে স্টুডিওতে এসে উপস্থিত হন নিক্সন। পরে কেনেডি। তবে বিতর্কের চেয়ে দুই প্রার্থীকে বিতর্কের সময় টেলিভিশনের পর্দায় কেমন দেখায়, সেটি নিয়েই যেন ছিল বাড়তি আগ্রহ। কারণ, হাঁটুর ব্যথা ও সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা নিক্সনকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। তবে আত্মবিশ্বাসী ও চাপমুক্তও মনে হচ্ছিল তাঁকে। অন্যদিকে কালো স্যুটে কেনেডিকে তুলনামূলক উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ওজন কমে যাওয়ায় তাঁর পোশাক ছিল ঢিলেঢালা।
বিতর্কের বেশির ভাগজুড়ে ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি। এর মধ্যে ছিল শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, শ্রম অধিকার ও কৃষির মতো বিষয়। এর বাইরে স্থান পেয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে চলা স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টিও। কেনেডি অভ্যন্তরীণ নীতির বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন।
বিতর্কে নিক্সন বলেছিলেন, ‘আমি জানি, দরিদ্র হওয়ার মানে কী। আমি জানি, বেকার লোকদের দেখার মানে কী। আমি জানি, সিনেটর কেনেডি আমার মতোই এই সমস্যাগুলো গভীরভাবে অনুভব করেন। কিন্তু আমাদের মতবিরোধ আমেরিকার লক্ষ্য নিয়ে নয়, শুধু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে।’
কেনেডি বলেন, ‘আমি সেই ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে এসেছি, যে দল এ শতাব্দীতে উড্রো উইলসন, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও হ্যারি ট্রুম্যানের মতো নেতা তৈরি করেছে। তাঁরা এ কর্মসূচিগুলো সমর্থন করেছেন ও চালিয়ে গেছেন, যা আমি আজ রাতে আলোচনা করেছি।’
নিক্সন অনেক প্রথাগত ধাঁচে বিতর্ক করেন। তিনি স্টুডিওতে থাকা দর্শকদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেনেডির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, বক্তব্য দেওয়ার বাইরের সময়টাতে নিক্সনকে অস্থির হয়ে স্টুডিওর দিকে তাকাতে দেখা যায়। বিপরীতে কেনেডি মনোযোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনছিলেন।
বিতর্ক শেষ হওয়ার পরপরই নিক্সন পেছনের দরজা দিয়ে চলে যান। অন্যদিকে ম্যাকক্লার্গ কোর্ট ভবনের সামনের দরজায় আসেন কেনেডি। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সন্ধ্যাটি আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছিল।’
বিতর্কের পর জরিপে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, এ বিতর্কে কেনেডি জিতেছেন। জরিপে আরও উঠে আসে, সাত কোটি দর্শকের মধ্যে দোদুল্যমান ও নির্দলীয় ভোটারদের বিশাল অংশ কেনেডিকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৬০ সালের ওই নির্বাচনের আগে আরও তিনটি বিতর্কে অংশ নেন কেনেডি ও নিক্সন। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও লস অ্যাঞ্জেলেসে এসব বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। শেষের বিতর্কগুলোয় ঘুরে দাঁড়ান নিক্সন। বিশেষ করে ওই বছরের ২১ অক্টোবর সর্বশেষ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিতর্কে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তিনি ভালো করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে জয়ী হন কেনেডি।
তথ্য সূত্র: সিবিএস, মার্কিন সিনেটের ওয়েবসাইট ও ওয়াশিংটন পোস্ট