যুক্তরাষ্ট্রে ভোটাররা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন রুটিরুজিতে
সব হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণিত করে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি অপ্রত্যাশিত, কিন্তু যেভাবে বিপুল ভোটে তিনি জয়ী হয়েছেন, সেটা আরও অপ্রত্যাশিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের অধিকাংশ কাউন্টি বা জেলায় বিগত দুবারের চেয়ে তিনি অধিক ভোট পেয়েছেন। কেন, কীভাবে, সে হিসাব করতে গিয়ে নিজেদের চুল ছিঁড়ছেন ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদেরা।
একটা বিষয় স্পষ্ট। কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতির যে নেতিবাচক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের ওপর পড়ে, ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে তার দায়ভার এড়ানো সম্ভব হয়নি। শত প্রতিশ্রুতি অথবা ট্রাম্প কতটা ভয়াবহ, তা বারবার বলেও ভোটারদের মনে আস্থা জাগাতে পারেননি ডেমোক্র্যাটরা। দেশের মানুষ ‘পরিবর্তনের’ জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অবিচল একজন শক্ত নেতার অপেক্ষায় ছিল তারা। শুধু এই দেশেই নয়, ইউরোপের একাধিক দেশেও আমরা দেখেছি কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষের মুখে রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। উত্থান হয়েছে তথাকথিত ‘স্ট্রং ম্যানের’।
কমলার প্রার্থিতা
ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য কমলা হ্যারিসকে দায়ী করা অন্যায় হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী প্রচার অভিযান পরিচালনা করতে মাত্র তিন মাস সময় তিনি পেয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিল, তারা মনে করে দেশ ভুল পথে চলছে। মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ বাইডেনের নেতৃত্বে সমর্থন জানায়। কমলা কিছুতেই জো বাইডেনের মতো এমন একজন অজনপ্রিয় রাজনীতিক থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারেননি। সেটা সম্ভবও ছিল না। তিনি এই প্রশাসনের দ্বিতীয় প্রধান নেতা, এই প্রশাসনের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোরই ভাগীদার তিনি।
কমলা তাঁর প্রচারের কেন্দ্রে গর্ভপাতের বিষয়টি রেখেছিলেন। ২০২০ ও ২০২২ সালে গর্ভপাতের প্রশ্নে নারী সমর্থনের জোরে ডেমোক্রেটিক পার্টি বৈতরণি পেরোতে পেরেছিল। ২০২৪ সালে সেটি আর নারী-পুরুষ কারও কাছেই প্রধান ইস্যু ছিল না। অনেক বেশি জরুরি ছিল দিন শেষে খাবার টেবিলে রুটি-মাখন জোগানোর প্রশ্ন।
কমলার আরও একটি ভুল ছিল প্রেসিডেন্ট হলে তিনি নতুন কী করবেন, তা ব্যাখ্যার বদলে অধিক মনোযোগী ছিলেন ট্রাম্প কতটা ভয়াবহ, সে কথা ব্যক্ত করতে। ১০ বছর ধরে দেশের মানুষ যাঁর (ট্রাম্প) কথা শুনে আসছে, সে বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কমলা বদলাতে পারেননি।
অভিবাসন
অর্থনীতি ছাড়া অন্য যে বিষয়টি সব ধরনের ভোটারদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, তা হলো অভিবাসন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই অবৈধ অভিবাসনকে কেন্দ্র করে একাধিক সরকারের পতন হয়েছে। ট্রাম্প বরাবরই ভোটারদের, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, বল্গাহীন অভিবাসনের ফলে আমেরিকার জনসংখ্যাগত চরিত্রে যেমন পরিবর্তন আসছে, তেমনি তার সাংস্কৃতিক, এমনকি ধর্মীয় চরিত্রেও বড় রকমের আঘাত আসছে। প্রচার চালানো হয়েছে মুসলিম আগমনের ফলে এ দেশে শরিয়াহ আইনের প্রবর্তন হবে। সে ভয়কে উসকে দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমাদের দেশ আর আমাদের হাতে নেই, সে এখন পৃথিবীর “ডাস্টবিন”, সারা পৃথিবীর খুনে, রোগগ্রস্ত, ধর্ষক ও সন্ত্রাসীরা ওই ডাস্টবিনে আশ্রয় পাচ্ছে।’
শুধু শ্বেতাঙ্গরাই নন, যেসব অভিবাসীর বিরুদ্ধে ট্রাম্প বিষ ঢেলেছেন, তাঁরাও সে কথা কানে তুলেছেন। ট্রাম্পের ক্রোধের মূল লক্ষ্য দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসীরা। অথচ এবার প্রথমবারের মতো হিস্পানিক অভিবাসী ভোটারদের ৫০ শতাংশের বেশি ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এ কথা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে অ্যারিজোনার মারিকোপা ও ইয়ুমা জেলায়, যেখানে বৈধ-অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ।
নিজেদের স্বার্থবিরোধী জানা সত্ত্বেও অভিবাসীরা কেন ট্রাম্পকেই সমর্থন করলেন? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর, যাঁরা ইতিমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে চলে এসেছেন অথবা বৈধতা অর্জন করেছেন, তাঁরা অতিরিক্ত অভিবাসী আগমন নিজেদের রুটিরুজি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি ভেবেছেন। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বহিরাগতদের অধিকাংশ ডেমোক্র্যাটদের ‘উদারনৈতিক’ মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। গর্ভপাত অথবা সমকাম ও লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এই দলের অবস্থান ও অতিরিক্ত আগ্রহ তাঁদের মনে মোটেই আস্থার সঞ্চার করেনি।
‘ড্যাডি ট্রাম্প’
ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বকেও তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন। এরা এমন সব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়নি। সে কারণে দুর্বল গণতন্ত্রমনা নেতার বদলে তারা ট্রাম্পের মতো একরোখা, দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী নেতাতেই অধিক আস্থা বোধ করেছে। ইউরোপের অনেক দেশেই ট্রাম্পের আদলে কর্তৃত্ববাদী ‘স্ট্রংম্যান’দের আবির্ভাবের পেছনেও এই মনোভাব কাজ করছে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, আফ্রিকান-আমেরিকানদের ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি একই কারণে ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে। এই সম্প্রদায়ের ভেতর অপরাধ, মাদকাসক্তি ও অব্যাহত দারিদ্র্য সংক্রামক ব্যাধির মতো যুগ যুগ ধরে বহাল রয়েছে। প্রথাগতভাবে আফ্রিকান-আমেরিকানরা ডেমোক্র্যাট সমর্থক। কিন্তু তারা দেখেছে ঝুরি ঝুরি প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা পরিবর্তন চেয়েছে। ট্রাম্পের দৃঢ় নেতৃত্ব, প্রচলিত নিয়ম ও আইন অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি তাদের আগ্রহী করেছে।
নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক নির্বাচনী সভায় রক্ষণশীল রেডিও হোস্ট টাকার কার্লসন ট্রাম্পকে এক ‘অতি কড়া পিতা’র সঙ্গে তুলনা করেন। সমালোচিত হওয়ার বদলে অনেকেই সে কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। এর ব্যাখ্যাটা এ রকম। আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক অনেক পরিবারেই একজন দায়িত্বশীল পিতার অভাব রয়েছে। এদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার বিস্তৃতির একটি কারণ এই অভাব। কার্লসনের কথায়, ট্রাম্প সেই অনুপস্থিত পিতা, যিনি ফিরে এসেছেন, প্রয়োজনে চাবুক দিয়ে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁর এই বক্তব্যের সময় ‘দুয়ো দুয়ো’ বলার বদলে ‘ড্যাডি এট হোম’ স্লোগান শোনা গেছে।
মধ্যপ্রাচ্য
গাজা ও লেবাননে অব্যাহত ইসরায়েলি আক্রমণ প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় কমলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—এ কথা এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাইডেন ইসরায়েলি আগ্রাসী নীতির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দেন, কমলা সেখান থেকে আসতে পারেননি। শুধু আরব, মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যেই নয়, এ দেশের প্রগতিশীল নারী-পুরুষ, বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে কমলা নিন্দিত হয়েছেন। তাঁর জন্য আরও দুর্ভাগ্যের কথা, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘নরম’ এই অভিযোগে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ইহুদি ভোটারদের কাছেও তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটদের ভিত্তিতে ভাঙন
এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট। ২০০৮ সালে বারাক ওবামার সময় অথবা তারও আগে থেকে যে জোটকে ডেমোক্রেটিক পার্টি তার ভিত্তি ভেবে এসেছে, তা ভেঙে পড়েছে। একসময় এই দলের প্রধান সমর্থক ছিল দেশের কর্মজীবী শ্রেণি ও আফ্রিকান-আমেরিকান নারী-পুরুষ। এই দুই গ্রুপের ক্রমবর্ধিত অংশ ডেমোক্র্যাটদের ত্যাগ করে রিপাবলিকানদের দলভুক্ত হয়েছে। এর জন্য অবশ্যই ট্রাম্পের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে এদের চোখে ডেমোক্রেটিক পার্টি শহুরে, শিক্ষিত নারী-পুরুষ সমর্থিত একটি ‘এলিটিস্ট’ দল। সাধারণ ও কম শিক্ষিত ভোটারদের মনে হয়েছে, এই দল তাঁদের রুটিরুজি নিয়ে ভাবার বদলে অনেক বেশি বিচলিত ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে অথবা গর্ভপাত নিয়ে। এসবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দিনের কাজ শেষে খাবার টেবিলের কথা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশিদের ভোট
সবশেষে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ট্রাম্পের প্রতি অস্বাভাবিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করব। সংখ্যায় তাঁরা তেমন উল্লেখযোগ্য নন। তাঁদের ভোটে নির্বাচনের ফলাফলে হেরফের হয়নি। অর্থনীতি, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও অভিবাসন সংকট—এই তিনটি প্রশ্নই তাঁদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে ও এ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের মধ্যে। এই দুই গ্রুপের সদস্যরাই মনে করেছেন, ট্রাম্প-মোদি বন্ধুত্ব তাঁদের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে।
ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পরদিন থেকেই তিনি এ দেশে বসবাসরত সোয়া কোটি বৈধ কাগজপত্রবিহীন-তাঁর ভাষায় অবৈধ-বহিরাগতদের জোরপূর্বক বহিষ্কার শুরু করবেন। প্রয়োজনে এই কাজে সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করবেন। প্রতি তিনজন বাংলাদেশির একজন-বা হয়তো তার চেয়েও বেশি ‘অবৈধ’। তাঁরা ট্রাম্পের খেদাও অভিযানের শিকার হবেন। আরও সোয়া কোটি অভিবাসী রয়েছে, যেখানে পিতা-মাতা অবৈধ অভিবাসী হলেও তাঁদের সন্তানেরা এ দেশে জন্মগ্রহণ করায় তারা বৈধ অভিবাসী। ট্রাম্পের খেদাও অভিযানে ছেলেমেয়ে এ দেশে থেকে যাবেন, বহিষ্কৃত হবেন তাঁদের পিতা–মাতা।
যাঁরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা কি এই অভাবিত মানবিক দুর্যোগ থেকে দায়িত্ব এড়াতে পারবেন? যখন তাঁদের প্রতিবেশী, নিকট আত্মীয় অথবা পরিচিত বাংলাদেশিরা বহিষ্কৃত হবেন, আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজের দায়ভার তাঁরা ঢাকতে পারবেন তো? কোনো বহিষ্কৃত পিতা–মাতার সন্তানদের কান্না দেখে নিজেদের ক্ষমা করতে পারবেন তো?