যুক্তরাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক
দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের গণতন্ত্রকে অনুকরণীয় হিসেবে দেখিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে স্বাধীনতা অর্জনের পর কিংবা স্বৈরশাসককে সরিয়ে দেওয়ার পর গণতন্ত্র পুনর্গঠনে কোনো দেশের জন্য দেশটি উদাহরণ হতে পারে।
জন এফ কেনেডি থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত সব রাজনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি প্রদীপ্ত বাতিঘর হিসেবে তুলে ধরেছেন। সবার নজর কেড়েছেন৷ ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে কেনেডি বলেছিলেন, বিশ্ব এখনো যুক্তরাষ্ট্র ও এর গণতন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘প্রতিটি শাখায়, প্রতিটি স্তরে, জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের সরকারগুলোকে হতে হবে বাতিঘর,’ বলেছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট পেতে হয়। ফলে জনগণের ভোট কেউ বেশি পেলেও ইলেকটোরাল ভোটের কারণে কম ভোট পাওয়া প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি সারা বিশ্বের চোখ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সেদিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে ডানপন্থি চরমপন্থিরা ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায়। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধা দেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
২০২৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় বার্তা সংস্থা এপির একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র খুব ভালোভাবে চলছে৷ তাহলে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দেশটির গণতন্ত্রের অবস্থা কী? চলুন সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
গণতন্ত্রের প্রতি আস্থায় অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে না মার্কিন কংগ্রেস
ম্যাককোর্টনি ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসির পরিচালক এবং পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল বার্কম্যান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটা বলতেই পারি, আমেরিকানদের এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি খুব বেশি আস্থা নেই৷’
মাইকেল বার্কম্যান আরও বলেন, তাঁরা (যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ) এমন একটি কংগ্রেসের দিকে তাকিয়ে আছেন, যা মোটেও ঠিকমতো কাজ করছে না। তাঁরা এমন কিছু জটিল সমস্যা দেখছেন, যা সরকার আসলেই সমাধান করেনি। যেমন আগ্নেয়াস্ত্রকেন্দ্রিক সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তন।
নেতা নির্বাচনে নিজেদের অক্ষমতার কারণে প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান পার্টি ২০২৩ সালের অক্টোবরে কয়েক সপ্তাহের জন্য কংগ্রেসকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। কিন্তু এমন বাধা ছাড়াই সিনেট থেকে আইন প্রণয়নের মতো জরুরি বিষয়গুলোও চলছে ধীরগতিতে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ভ্যানেসা উইলিয়ামসন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বেশির ভাগ জনসমর্থন পেয়েও আইন পাস করা খুব কঠিন। কখনো কখনো অসম্ভব। ওয়াশিংটনের কাজের ক্ষেত্রে গুরুতর অবহেলা রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তাতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের জনবহুল অঞ্চলগুলোর জনগণের আকাঙ্ক্ষা ঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।
সর্বশেষ নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর দেখেনি যুক্তরাষ্ট্র
কঠোর মেরুকরণ, ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব—এর অর্থ হলো, নির্বাচিত সরকারের নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট থাকে দেশের অর্ধেক মানুষ।
২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বে অনেক রিপাবলিকান বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা দাবি করেন, নির্বাচনে তাঁদের উপেক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি নির্বাচনটি তাঁদের কাছ থেকে ‘চুরি’ করা হয়েছে বলেও দাবি ছিল তাঁদের। ফলে ক্যাপিটল ভবনে আক্রমণ করতেও পিছপা হয়নি তারা। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর গণতন্ত্রণের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনার নজির নেই বললেই চলে।
অধ্যাপক মাইকেল বার্কম্যান বলেন, ‘আমিও মনে করি, ৬ জানুয়ারি যা ঘটেছিল এবং নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে একটি পক্ষের অস্বীকৃতি গণতন্ত্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ, নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অনেক বেশি জরুরি।’
ইলেকটোরাল কলেজ: ভোটে জয়ী হওয়াই মুখ্য নয়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে গেলেও তা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে এমনটা হয়তো কেউই আশা করেন না।
ভ্যানেসা উইলিয়ামসন বলেন, গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্রবিরোধী চর্চা রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে সর্বাধিক ভোট পাওয়া যথেষ্ট নয়। এ কারণে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলেও তাঁর প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটন তাঁর চেয়ে ২৯ লাখ বেশি ভোট পেয়েছেন। এমন পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ইলেকটোরাল কলেজ।
যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটিতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। যে প্রার্থী একটি রাজ্যের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাবেন, তিনি সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট নিজের পকেটে পুরবেন। একটু কঠিন লাগছে? উদাহরণটি দেখে নিন।
সবচেয়ে জনবহুল অঙ্গরাজ্য হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ায় সর্বোচ্চসংখ্যক ৫৪টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে প্রার্থী ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশি ভোট পাবেন, রাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট তিনিই পাবেন। ভারমন্ট বা সাউথ ডাকোটার মতো ছোট রাজ্যে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট মাত্র তিনটি করে। সেখানেও একই নিয়ম, ভোটে যিনি জিতবেন, তিনটি ইলেকটোরালই তার।
প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট পেতে হয়। ফলে জনগণের ভোট কেউ বেশি পেলেও ইলেকটোরাল ভোটের কারণে কম ভোট পাওয়া প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন।
মার্কিন সিনেট—‘ভীষণ অগণতান্ত্রিক একটি প্রতিষ্ঠান’
মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরেকটি দিক হলো, কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট নিখুঁত গণতন্ত্রকে প্রতিফলিত করে না। একটি রাজ্যের জনসংখ্যা যা–ই হোক না কেন, প্রতিটি রাজ্যের চেম্বারে দুজন সিনেটর থাকেন।
এর মানে হলো, কিছু রাজ্যে একজন সিনেটর কয়েক লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। আবার কোনো ক্ষেত্রে কোটি মানুষের জন্যও সিনেটরের সংখ্যা মাত্র একজন। সিনেটে যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন প্রতিটি সিনেটরের ভোটও সমান। যদিও তারা বিভিন্ন সংখ্যার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন।
বার্কম্যান সিনেটকে ‘একটি ভীষণ অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
উইলিয়ামসন বলেন, সিনেটকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তাতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের জনবহুল অঞ্চলগুলোর জনগণের আকাঙ্ক্ষা ঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।
তবু অংশগ্রহণ বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের জন্য হয়তো মডেল নয়, তবু আমেরিকানরা এই পদ্ধতি ছেড়ে দেননি। বরং আরও অনেক মানুষ এই পদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশের বেশি। এটি শত বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতির রেকর্ড।
বার্কম্যান বলেন, ‘আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। গত ৮-১০ বছরে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমি মনে করি, এটি গুরুত্বপূর্ণ।’