কমলা শিবিরে আশার আলো

কমলা হ্যারিসফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে ডেমোক্র্যাটদের অতিরিক্ত ভীত হওয়ার কথা সুবিদিত। এই অভ্যাসকে তারা নিজেরাই ঠাট্টা করে ‘নিশিরাতে শয্যা ভেজানো’ নামে অভিহিত করে থাকে। এবারও, নির্বাচনের মুখে এসে ঠিক সে ঘটনাই ঘটবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ভীত ও উদ্বিগ্ন অনেক ডেমোক্র্যাট নির্বাচনী বিশেষজ্ঞই স্বীকার করেছেন, এই নির্বাচনে ট্রাম্পকে ঠেকানো কঠিন।

তবে খুব সামান্য হলেও এই ‘অন্ধকার ও হতাশা’ কাটিয়ে আলোর মুখ দেখছে কমলা হ্যারিস ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টি। না, জনমত জরিপে অবস্থার কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন আসেনি। কাগজে-কলমে এই নির্বাচন এখনো ৫০-৫০। কিন্তু দুই দিন আগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক নির্বাচনী সভায় এসে ট্রাম্প ও তাঁর প্রচারশিবিরের পক্ষ থেকে কমলার হাতে একটি ‘উপহার’ তুলে দেওয়া হয়েছে।

অধিকাংশ জরিপ অনুসারে, এবারের নির্বাচনে প্রতি পাঁচজনের একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। এই সংখ্যা আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণ ও যুবকদের মধ্যে আরও বেশি। বস্তুত কলেজ-শিক্ষিত নয়, এমন সব গ্রুপের মধ্যেই ট্রাম্পের প্রতি লক্ষণীয় সমর্থন রয়েছে।

ভাসমান জঞ্জালের দ্বীপ

১৯৩৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে, এই ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আমেরিকার নাৎসিপন্থীরা হিটলারের সমর্থনে প্রায় ২০ হাজার লোকের অংশগ্রহণে এক সভার আয়োজন করেছিল। সেই সভার মূল বক্তব্য ছিল, সবার আগে আমেরিকা (আমেরিকা ফার্স্ট)। ট্রাম্পের সভারও সেই একই বক্তব্য ছিল, ‘আমেরিকা হবে আমেরিকানদের জন্য’। এই সভায় যে কট্টর ও কুৎসিত ভাষায় বহিরাগতদের আক্রমণ করা হয়, তা ছিল অভূতপূর্ব। তাতেও কোনো সমস্যা হতো না। এমন আক্রমণ তো ট্রাম্প প্রতিদিনই করে যাচ্ছেন। গোল বাধল ট্রাম্পের পক্ষে একজন কমেডিয়ানের বক্তব্য ঘিরে। উপস্থিত ট্রাম্প–ভক্তদের হাস্যরোলের মধ্যে এই কমেডিয়ান ঘোষণা করলেন, পুয়ের্তোরিকো হচ্ছে একটি ‘ভাসমান জঞ্জালের দ্বীপ’। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বহিরাগতদের নাম নিয়ে তিনি বললেন, এরা একটা কাজই পারে, আর তা হলো সন্তান উৎপাদন। কথায় ও ভঙ্গিতে কদর্য ইঙ্গিত করে বিষয়টি তিনি বুঝিয়ে বললেন।

জনমত জরিপে অবস্থার কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন আসেনি। কাগজে-কলমে এই নির্বাচন এখনো ৫০-৫০। কিন্তু দুই দিন আগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক নির্বাচনী সভায় এসে ট্রাম্প ও তাঁর প্রচারশিবিরের পক্ষ থেকে কমলার হাতে একটি ‘উপহার’ তুলে দেওয়া হয়েছে।

পুয়ের্তোরিকো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দ্বীপ। একে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উপনিবেশ বলাই ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে পুয়ের্তোরিকো থেকে আগত প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস। এদের একাংশও যদি এই কদর্য বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে নির্বাচনী ফলাফলে চমক আসতে পারে। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ পেনসিলভানিয়া, সেখানে পুয়ের্তোরিকোর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের বাস। জিততে হলে ট্রাম্প অথবা কমলা উভয়কেই এই অঙ্গরাজ্যের ১৯টি ইলেকটোরাল ভোট কবজা করতে হবে। এ অবস্থায় পুয়ের্তোরিকানদের লক্ষ্য করে এমন কুৎসিত মন্তব্য ট্রাম্পের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেছে। সে কথা টের পেয়ে ট্রাম্প মঙ্গলবার পেনসিলভানিয়া এসেছিলেন আগুন থামাতে। ঠিক ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ না করলেও তিনি দাবি করেন, পুয়ের্তোরিকোর জন্য তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ করেনি, করবেও না।

আরও পড়ুন

পুয়ের্তোরিকোর নাগরিকদের অবশ্য মনে থাকতে পারে, ২০১৯ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি যখন প্রবল সংকটে পড়ে, সে সময় ট্রাম্প অতিরিক্ত ত্রাণ পাঠাতে আপত্তি করে রিপাবলিকান কংগ্রেস নেতাদের বলেছিলেন, বড় বেশি ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে সেখানে। পরে নিজে সে দ্বীপে দুর্যোগ দেখতে এসে ত্রাণ হিসেবে পেপার টাওয়েল ছুড়ে ছুড়ে মেরেছিলেন।

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্পের নির্বাচনী সভার পরপরই এই দ্বীপের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন সেলিব্রিটি—জেনিফার লোপেজ, ব্যাড বানি ও রিকি মার্টিন কমলার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। পুয়ের্তোরিকোর সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক এল নুয়েভো দিয়াও কমলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বাতাস ট্রাম্পের বিপক্ষে বইছে টের পেয়ে কমলার প্রচারশিবিরের পক্ষ থেকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প এই দ্বীপের প্রতি কী ব্যবহার করেছেন। ত্রাণপ্রার্থীদের উদ্দেশে ট্রাম্পের খেলাচ্ছলে পেপার টাওয়েল ছুড়ে মারার ভিডিও সংবলিত একটি বিজ্ঞাপন এখন পুয়ের্তোরিকান অধ্যুষিত অঞ্চলে অহরহ দেখানো শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন

মিশিগান

পেনসিলভানিয়া ছাড়া অন্য যে ‘দোদুল্যমান’ (ব্যাটলগ্রাউন্ড) অঙ্গরাজ্যে কমলা ও ট্রাম্প দুজনকেই জিততে হবে, তা হলো মিশিগান। গাজা প্রশ্নে মুসলিম ও আরব ভোটাররা বাইডেন-কমলা প্রশাসনের ইসরায়েলপ্রীতিতে অসন্তুষ্ট, সে কারণে এখানে কমলা বিপাকে পড়তে পারেন। ডেমোক্র্যাটদের ‘শাস্তি’ দিতে অনেক আরব হয় ট্রাম্প অথবা গ্রিন পার্টির জিল স্টাইনকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন।

দুই দিন আগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক নির্বাচনী সভায় এসে ট্রাম্প ও তাঁর প্রচারশিবিরের পক্ষ থেকে কমলার হাতে একটি ‘উপহার’ তুলে দেওয়া হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বাস্তব অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। কমলার প্রচারশিবিরের নিজস্ব জরিপ অনুসারে যে পরিমাণ বিরুদ্ধ ভোটের আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা সত্যি না–ও হতে পারে। মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায় শুধু আরব ভোট নয়, ইহুদি ভোটও গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকাটি জানিয়েছে, সম্প্রতি ট্রাম্পের সাবেক চিফ অব স্টাফ জন কেলি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প ‘হিটলার অনেক ভালো কাজও করেছে’ বলে মন্তব্য করেন। তাঁর এই মন্তব্য ইহুদি ভোটারদের মোটেও ভালো লাগেনি। মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ার ক্রুদ্ধ ইহুদি ভোটাররা কমলার বাক্সে ভোট দিতে পারেন বলে ভাবা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

মিশিগানে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের মধ্যেও গাজা প্রশ্নে কমলার প্রতি অসন্তোষ রয়েছে। আরব ও মুসলিমদের মতো তাঁরাও ডেমোক্র্যাটদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ট্রাম্পের দিকে এগোতে পারেন। তবে বাঙালি অধ্যুষিত শহর হ্যামট্রমিকের অন্যতম সিটি কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ হাসান বলেছেন, তাঁর বিশ্বাস, ৭০ শতাংশ বাংলাদেশি কমলাকে সমর্থন করবেন। মঙ্গলবার এক টিভি টক শোতে তিনি আমার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ট্রাম্প এক সময় মুসলিমদের সন্ত্রাসী বলেছিলেন ও তাঁদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ‘মুসলিম ব্যান’ আরোপ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সে কথা ভুলিনি।’ তাঁর ধারণা, বড়জোর ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন।

মোহাম্মদ হাসান আশঙ্কা করেন, বাংলাদেশের বিগত সরকারের সমর্থকেরা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেওয়ার কথা বলছেন। তাঁদের ধারণা, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি ড. ইউনূসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যবস্থা নেবেন।

আফ্রিকান-আমেরিকান ভোট

গত চার-পাঁচটি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রায়-নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে এসেছে। এবার অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। অধিকাংশ জরিপ অনুসারে, এবারের নির্বাচনে প্রতি পাঁচজনের একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। এই সংখ্যা আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণ ও যুবকদের মধ্যে আরও বেশি। বস্তুত কলেজ-শিক্ষিত নয়, এমন সব গ্রুপের মধ্যেই ট্রাম্পের প্রতি লক্ষণীয় সমর্থন রয়েছে। সে কারণে গত কয়েক সপ্তাহ কমলার প্রচারশিবির নানাভাবে আফ্রিকান-আমেরিকানদের দলে টানার চেষ্টা চালিয়েছে। এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামা।

সম্ভবত এই প্রচারে কিছুটা কাজও দিয়েছে। মঙ্গলবার আফ্রিকান-আমেরিকানদের সংগঠন এনএএসিপির এক জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে। এই জরিপ অনুসারে আগস্টের তুলনায় পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের মধ্যে কমলার সমর্থন ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে এই গ্রুপের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন ২৭ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।