বাবার দেওয়া খেলনা থেকেই উড়োজাহাজ উদ্ভাবনের নেশা

উড়োজাহাজ উদ্ভাবন করে বিশ্বের মানুষকে উড়তে শেখান উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট। পিঠাপিঠি দুই ভাইকে ‘রাইট ব্রাদার্স’ নামেই চেনে বিশ্ব। বড় ভাই উইলবারের জন্মদিন আজ ১৬ এপ্রিল।

নিজেদের তৈরি ফ্লায়ারে (একধরনের আকাশযান) রাইট ভাইয়েরা। দুই ভাই মাত্র একবারই একসঙ্গে উড়োজাহাজে চড়েছিলেনবেটম্যান আর্কাইভের সৌজন্যে

উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট। পিঠাপিঠি দুই ভাইকে ‘রাইট ব্রাদার্স’ নামেই চেনে বিশ্ব। কিংবদন্তি এই দুই উদ্ভাবক উড়োজাহাজ উদ্ভাবন করেন এবং বিশ্বের মানুষকে উড়তে শেখান। বড় ভাই উইলবারের জন্মদিন আজ ১৬ এপ্রিল।

উইলবার ১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের মিলভিলের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের চার বছর পর ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটনে জন্মগ্রহণ করেন অরভিল। বড় ভাইয়ের জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক উড়োজাহাজ উদ্ভাবনে দুই ভাইয়ের সাধনার গল্প।

খেলনা থেকে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন

শিশুকালেই দুই ভাইয়ের মনে আকাশজয়ের নেশা দানা বেঁধেছিল। জানা যায়, বাবার দেওয়া একটি খেলনা হেলিকপ্টার তাঁদের মনে বুনে দিয়েছিল স্বপ্নের বীজ। ১৮৭৮ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন বাবা মিল্টন রাইট। এ সময় ছোট দুই ছেলের জন্য আনা একটি উপহার বাসার মধ্যেই ওপরে ছুড়ে মারেন বিশপ বাবা।

১৯০৮ সালে একটি ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুই ভাই বলেন, ‘ধারণা করছিলাম খেলনাটি মেঝেতে পড়ে যাবে। কিন্তু মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পরিবর্তে কক্ষের ছাদের অংশে ধাক্কা লাগার আগপর্যন্ত এটি উড়তে থাকে। ধাক্কা লেগে এটি উল্টে যায় এবং মেঝেতে পড়ে যায়।’

কর্ক, বাঁশ ও কাগজ দিয়ে তৈরি এবং রাবার ব্যান্ড দ্বারা চালিত হেলিকপ্টার মডেলটি দুই ভাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। এ ধরনের আকাশযানের প্রতি তাঁদের মধ্যে তুমুল আবেগ তৈরি হয়। আকাশে ওড়ার স্বপ্ন রীতিমতো নেশার মতো কাজ করে দুই ভাইয়ের মধ্যে।

যদি লক্ষ্য থাকে অটুট

এই স্বপ্ন পূরণ এতটা সহজ ছিল না রাইট ভাইদের জন্য। এর বড় কারণ ছিল এ ধরনের আকাশযান তৈরির প্রকৌশল জ্ঞান এবং আর্থিক সংস্থানের অভাব। দুজনেরই হাইস্কুলে থাকার সময় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরে একজন ডিপ্লোমা করতে পেরেছিলেন। অর্থের ব্যবস্থা করাও এতটা সহজ ছিল না দুজনের জন্য।

দুই ভাই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পত্রিকা আর ছাপাখানার ব্যবসা দিয়ে। তবে এ ব্যবসায় তেমন সফল হননি তাঁরা। এরপর দুই ভাই ‘দ্য রাইট সাইকেল কোম্পানি’ নামে বাইসাইকেলের ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে ভাড়া দেওয়া বা যন্ত্রাংশ বেচাকেনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও শিগগিরই তাঁরা নতুন নতুন নকশায় সাইকেল তৈরি করতে শুরু করেন। ২০ বছর এই ব্যবসা করে আয়রোজগারও করলেন বেশ।

এরপর শুরু হলো আসল স্বপ্নের পথে যাত্রা। ১৮৯৯ সাল থেকে শুরু হলো গবেষণা। ১৯০০ সালে তৈরি করলেন প্রথম গ্লাইডার (একধরনের উড়োযান)। ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত নিরলসভাবে চলতে থাকে প্রচেষ্টা। অনেকবারই দুই ভাইয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তাঁরা হাল ছাড়েননি। একবার উড্ডয়নের চেষ্টা ব্যর্থ হলে ত্রুটি সারিয়ে এবং আরও নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে আবার নেমে পড়েন দুই ভাই।

এই ফ্লায়ার দিয়েই উড্ডয়নের পরীক্ষায় প্রথম সফলতা পান রাইট ভাইয়েরা
ছবি: স্মিথসোনিয়ান এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের সৌজন্যে

অবশেষে ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে আসে সাফল্য। ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা। নর্থ ক্যারোলাইনার কিটি হকসংলগ্ন কিল ডেভিল হিল। গ্যাসোলিন ইঞ্জিনচালিত ফ্লায়ারের (আকাশযান) পাটাতনে চড়ে বসলেন অরভিল। পাইলটসহ এটির ওজন ছিল ৩৪০ কেজি। ইঞ্জিন চালু হলো। ঠিক ১০টা ৩৫ মিনিট। অরভিলকে বুকে নিয়ে শূন্যে উড়াল দিল ফ্লায়ার। আকাশে ছিল মাত্র ১২ সেকেন্ড। সামনের দিকে উড়ে যায় ১২০ ফুট (৩৬ মিটার)। তাতে কী! এই ১২ সেকেন্ডই পৃথিবীর গতিপথকে চিরতরে বদলে দিল।

চার ব্যক্তি রাইট ভাইদের এই উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রত্যক্ষ করেন। তাঁদের একজন ছবি তোলেন। অবশ্য খুব কম সংবাদপত্রই ঘটনাটি নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল।

এই পরীক্ষাকে উড়োজাহাজ উড্ডয়নের প্রথম কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসেবে দেখা হয়। এরপর দফায় দফায় আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান দুই ভাই। শেষ পর্যন্ত রাইট ভাইদের হাত ধরে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয় মানুষের।

দুই ভাইয়ের একসঙ্গে উড়তে মানা

দুই ভাই মাত্র একবারই একসঙ্গে উড়োজাহাজে চড়েছিলেন। কারণ, অরভিল ও উইলবার তাঁদের বাবাকে দুই ভাইয়ের একসঙ্গে উড়োজাহাজে না চড়ার কথা দিয়েছিলেন। বাবা মিল্টন রাইটের আশঙ্কা ছিল, কোনো এক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় দুই ছেলেকে একসঙ্গে হারাতে পারেন তিনি।

তবে ১৯১০ সালের ২৫ মে দুই ছেলেকে একবার একসঙ্গে উড়োজাহাজে চড়তে দিয়েছিলেন বাবা। ডেটনে ছয় মিনিটের এই ফ্লাইটে উড়োজাহাজ চালান অরভিল। যাত্রী হিসেবে ছিলেন উইলবার।

অবতরণ করার পর অরভিল প্রথম এবং একবারের জন্যই তাঁর ৮২ বছর বয়সী বাবাকে উড়োজাহাজে তোলেন। অরভিল যখন উড়োজাহাজ চালিয়ে উঁচুতে উঠছিলেন, তখন তাঁর উচ্ছ্বসিত বাবা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আরও উঁচুতে অরভিল, আরও উঁচুতে।’

বিশ্বে মর্যাদার আসনে সত্যিই অনেক উঁচুতে উঠেছেন দুই ভাই। রাইট ভাইদের প্রতি সম্মান জানাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১৭ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘রাইট ব্রাদার্স ডে’।

সূত্র: ন্যাশনাল অ্যাভিয়েশন হেরিটেজ এরিয়া (ভিজিটনাহা ডটকম), ভয়েস অব আমেরিকা