যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গত শনিবার দলেবলে হাজির হয় পুলিশ। জানায়, গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের বিরোধিতা করে ওই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে যাঁরা বিক্ষোভ করছেন, তাঁদের মধ্য থেকে বহিরাগতদের হটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ পেয়েছে তারা। এক ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু বহিরাগত নয়, শিক্ষার্থীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষার্থীরা যেসব তাঁবু খাঁটিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন, তার অনেকগুলোই ভেঙে ফেলা হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পাল্টা বিক্ষোভ শুরু হয়। অঙ্গরাজ্য পুলিশের কর্মকর্তারা তখন যাকেই সন্দেহ হচ্ছিল, তাকেই তুলে নিয়ে যেতে থাকেন। এতে ঘটনাস্থলে উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
নর্থইস্টার্ন ক্যাম্পাস প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিক্ষোভে বহিরাগতদের অংশগ্রহণের কারণে উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল। তাই তাঁরা পুলিশ ডাকতে বাধ্য হয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা ইহুদিবিদ্বেষী স্লোগান দিয়েছেন। তবে বিক্ষোভকারীরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ধরপাকড় চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোরই একটি নর্থইস্টার্ন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা যে দাবি জানিয়েছে, তা–ও প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নিতে শুরু করে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিক্ষোভকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে হয়রানি করছে ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে—এমন দাবি করে তাঁদের তাঁবু ভেঙে দেওয়া হয়। তখন থেকে বিক্ষোভকারীদের দাবি তো মানা হচ্ছেই না, বরং কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনের দখল নিলে কর্তৃপক্ষ তাদের বহিষ্কারের হুমকি দেয়। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের হটিয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে মঙ্গলবার রাতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের এমন উত্তেজনা চললেও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখিয়ে দিয়েছে, চাইলে সংঘাত, বিশৃঙ্খলা এবং উত্তেজনা এড়ানো যায়।
তেমন চিত্রই নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে। শিকাগো অঙ্গরাজ্যের খুব কাছে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার চিত্রটা নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ শুরুর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁবু স্থাপন করা নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করে। তবে তারা অঙ্গরাজ্য পুলিশকে ডাকেনি। কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। ক্যাম্পাস পুলিশের কর্মকর্তারাও ধীরে ধীরে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছেন।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি সমঝোতা চুক্তি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা যদি তাঁবু সরিয়ে নেন এবং বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সুযোগ শুধু শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন, তবে ১ জুন ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সেখানে অবস্থান নিতে দেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি কোম্পানি ও অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে পুরোপুরি রাজি হয়নি। তবে তারা বলেছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বাড়াতে তাদের বিনিয়োগ কমিটি নতুন করে কাজ শুরু করবে।
নর্থওয়েস্টার্ন কর্তৃপক্ষ দুই ফিলিস্তিনি শিক্ষক ও পাঁচ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর জন্য তহবিল বরাদ্দেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সেখানে সমঝোতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, অন্তত এখনকার জন্য হলেও।
নর্থওয়েস্টার্ন ও নর্থইস্টার্ন দুটিই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই অবস্থান দুটি বামপন্থী ধারার অঙ্গরাজ্যে। তাহলে একই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ লরেন লাসাবে শেপার্ড বলেন, ফিলিস্তিনপন্থীদের এ বিক্ষোভে সহিংসতার মাত্রা ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের যুদ্ধবিরোধী সহিংস বিক্ষোভের স্তরে পৌঁছায়নি। ওই সময় কিছু শিক্ষার্থী মার্কিন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।
লরেন লাসাবে শেপার্ডের মতে, এবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিক্ষোভ সামাল দিতে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে পুলিশ ডেকে আনার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
শেপার্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস পুলিশ আছে। তারা পোশাকধারী এবং ক্যাম্পাসে পূর্ণ সময়ের জন্য নিয়োজিত থাকে। তারা গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রাখে। সেখানে পৌর পুলিশ কিংবা ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের ডেকে পাঠানোকে উচ্চ ঝুঁকি মোকাবিলাসংক্রান্ত একটি কৌশল বলে মনে করা হয়।
গত সপ্তাহে আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাও নগর ও অঙ্গরাজ্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারপারসন নোয়েল ম্যাকাফিও আছেন।
বিবিসিকে ম্যাকাফি বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছিল। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার পরই বিক্ষোভকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে।
নর্থ ওয়েস্টার্নের মতো করেই গতকাল মঙ্গলবার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ভোটাভুটি আয়োজন করার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।
১৯৬০-এর দশকে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এবার সেখানে তাঁবু খাটিয়ে বিক্ষোভ চললেও তা বেশ শান্তিপূর্ণভাবে ও নির্বিঘ্নে চলছে।
টেনেসি অঙ্গরাজ্যের মিডল টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রি স্পিচ সেন্টারের পরিচালক কেন পলসন বলেন, কংগ্রেসের উচ্চপর্যায়ের সদস্যরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজনৈতিক চাপের কারণে কিছু প্রশাসক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্টো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
পলসন আরও বলেন, কলেজের প্রেসিডেন্টরা ক্রমাগত কংগ্রেস এবং বিশ্বকে দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাঁরা কলেজের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যথেষ্ট কঠোর। আর তা ৬০-এর দশকের শেষের দিকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন আইনপ্রণেতারা কলেজের প্রেসিডেন্টদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, তাঁরা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সামাল দিতে ব্যর্থ।
পলসনের মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতাদের ওপর এই চাপ অনেক বেশি। কারণ, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তমতের অধিকার নিশ্চিত করাটা জরুরি নয়। সে কারণে তারা আইনপ্রণেতাদের বলতে পারে না, সংবিধান অনুসারে তাদের হাত-পা বাঁধা, তারা কিছু করতে পারবে না।
তবে পলসনের ধারণা, বিক্ষোভ পরিস্থিতির এ সময়টা এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনেরই অনুকূলে।
কারণ, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভে শামিল হয়নি এবং তারা সহজে শিক্ষা বছরটি পার করার চেষ্টা করছে। এরপরও স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানে বিক্ষোভের প্রভাব পড়তে পারে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান বাতিল করেছে বা করার কথা ভাবছে।
নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ লরেন লাসাবে শেপার্ড যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ইতিহাসের ভিত্তিতে বলেন, বসন্তকালীন সেমিস্টার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগামী এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ ব্যাপক আন্দোলন হতে যাচ্ছে।